কেন্দ্রে উচ্ছ্বাস, রাজ্যে হতাশাই

অফিস বরাদ্দেই থমকে বাংলার উদ্যোগ

দিল্লির কাছে যা ‘কলকাতার রসগোল্লা’, কলকাতার জন্য সেটাই ‘দিল্লি কা লাড্ডু।’ বুধবার সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ মোদী সরকার মেনে নেওয়ার পরে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মীদের অবস্থাটা অনেকটা এ রকম!

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ০৪:০৪
Share:

দিল্লির কাছে যা ‘কলকাতার রসগোল্লা’, কলকাতার জন্য সেটাই ‘দিল্লি কা লাড্ডু।’ বুধবার সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ মোদী সরকার মেনে নেওয়ার পরে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মীদের অবস্থাটা অনেকটা এ রকম!

Advertisement

এ দিন সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে নিয়ে দিল্লি জানিয়েছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বর্ধিত হারে বেতন পাবেন কেন্দ্রের কর্মচারীরা। সে জায়গায় পশ্চিমবঙ্গের বেতন কমিশনের অবস্থা এখনও ন যযৌ ন তস্থৌ। কর্মীদের ৫০% মহার্ঘভাতা (ডিএ) বকেয়া রেখে প্রায় আট মাস আগে ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তার পরে এত দিনে কমিশনের জন্য শুধু অফিসটুকুই বরাদ্দ হয়েছে। কাজকর্মে সেই অর্থে হাত পড়েনি। নবান্নের খবর: ২০১৮-র আগে রাজ্য বেতন কমিশনের সুপারিশ জমা পড়ার সম্ভাবনা কম।

অর্থাৎ, রাজ্য কর্মচারীদের কপালে শিকে ছেঁড়ার আশু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে তদানীন্তন ইউপিএ-২ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সপ্তম বেতন কমিশন গঠন করেছিলেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল, ২০১৬-র ১ জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় কর্মীরা নতুন হারে বেতন পাবেন। মোদী সরকার সেই প্রতিশ্রুতি বজায় রেখে কাল, শুক্রবার (১ জুলাই) থেকে নতুন বেতনহার কার্যকর করতে চলেছে। জানুয়ারি থেকে বকেয়া ছ’মাসের বর্ধিত মাইনে কর্মচারীরা পেয়ে যাবেন ধাপে ধাপে। এর আগে কেন্দ্রীয় ষষ্ঠ বেতন কমিশন কার্যকর হয়েছিল দশ বছর আগে, ২০০৬-এ।

Advertisement

অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মীরা এখন পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক বেতন পাচ্ছেন। সুপারিশটি ২০০৬-এ কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে তার প্রায় তিন বছর বাদে। বর্ধিত বেতনের ওই তিন বছরের বকেয়ার পুরোটাও কর্মীরা পাননি। ইতিমধ্যে অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকারকে মাথায় বসিয়ে ২০১৫-র ২৭ নভেম্বর ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠন করেছে মমতা সরকার। গত মে মাসে ছ’মাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তার আয়ু আরও ছ’মাস বাড়ানো হয়েছে।

তবে উদ্যোগ মোটামুটি ওখানেই থমকে আছে। নবান্ন সূত্রের খবর, সাত মাস কেটে গেলেও সল্টলেকের বিকাশ ভবনে কমিশনের বরাদ্দ অফিসটি সে ভাবে চালু হয়নি। চেয়ারম্যান বা অন্য সদস্যেরা বিকাশ ভবনে নিয়মিত আসেন না। এমনকী, কমিশনের সদস্য-সচিব হিসেবে নিযুক্ত অর্থ দফতরের অফিসার দূর্গাকিঙ্কর মহাপাত্রও অফিস করেন নবান্নে। বিকাশ ভবনের দফতরে গুটিকয় কর্মী আর এক জন বিশেষ অফিসার কার্যত মর্জিমাফিক যাতায়াত করেন বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর।

এক কর্তা জানাচ্ছেন, গত সাত মাসে কমিশন বসেছে সাকুল্যে এক বার। সেখানে বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন ও সরকারি, আধা সরকারি সংস্থার কাছে দাবিপত্র চেয়ে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। অন্তত সাতশো স্মারকলিপি জমা পড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি স্মারকলিপি নিয়ে কমিশন শুনানি করবে। কিন্তু সে কাজ শুরু হয়নি। এ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে এ দিন কমিশনের চেয়ারম্যান অভিরূপবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি মুখে কুলুপ এঁটেছি। একটি কথাও বলব না।’’

চেয়ারম্যান মুখে কুলুপ আঁটলেও অর্থ দফতরের একাধিক কর্তার ধারণা, রাজ্যের ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হতে পারে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে। সে ক্ষেত্রে কমিশন হয়তো ২০১৮-র শেষ নাগাদ রিপোর্ট জমা দেবে। বস্তুত কমিশনকে ‘যথেষ্ট সময় নিয়ে ভেবে-চিন্তে’ রিপোর্ট বানাতে বলেছেন নবান্নের কর্তারা। কারণ, রাজ্যের ভাঁড়ারে বিস্তর টানাটানি। কমিশন আগে-ভাগে রিপোর্ট জমা দিলে সরকারের উপরে চাপ বাড়বে বিলক্ষণ।

কী রকম?

প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার ব্যাখ্যা: পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ মানতে গিয়ে এক ধাক্কায় বেতন খাতে ৫৮.৯২% ও পেনশন খাতে ৪৬.৮৭% খরচ বেড়েছিল রাজ্যের। সামাল দিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বাজার থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। আগের সরকার ২০০৮-এ যেখানে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, বর্ধিত বেতনের চাপ মোকাবিলায় পরবর্তী দু’ছরে দেনার বহর বেড়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটিতে পৌঁছয়।

এবং ঋণ গ্রহণের সেই ধারা চলছেই। প্রশাসনের তথ্য বলছে, দশ বছর আগের নেওয়া ঋণের আসল অংশ পরিশোধ করা শুরু হবে ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে। আগামী পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গকে বছরে গড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকার দেনা শুধতে হবে। এমতাবস্থায় বাড়তি বেতনের বোঝা ঘাড়ে নেওয়া এখনই সম্ভব নয়। ‘‘এই কারণেই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র চেয়েছিলেন, আগামী চার বছর রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বর্ধিত বেতন দিতে যে ৮৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা দরকার, তা চতুর্দশ অর্থ কমিশন রাজ্যকে দিয়ে দিক,’’ মন্তব্য নবান্নের এক সূত্রের।

সে দাবি ধোপে টেকেনি। ফলে রাজ্য সরকারি কর্মীদের কাছে এই মুহূর্তে দিল্লির বেতনহারকে ছুঁতে পারাটা নিছক ‘মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন