পুলিশি নিরাপত্তায় রেল চলল স্বাভাবিক ছন্দে

এ ভাবে রেহাই মিলবে না বুঝে হামাগুড়ি দিয়ে একটি ট্রেনের তলা দিয়ে কোনও মতে আমরা দু’জন দাঁড়িয়ে-থাকা আর একটি ট্রেনের কামরায় উঠে পড়লাম। উঠে দেখি, সেখানে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর। একটানা পাথরবৃষ্টি চলছে।

Advertisement

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৬
Share:

ট্রেনের উইন্ড স্ক্রিন-সহ সমস্ত জানলার কাচ ভেঙে দেওয়া হয়।— ফাইল চিত্র।

অবরোধের আশঙ্কা ছিল। উদ্বেগ ছিল গণ্ডগোল নিয়েও। কিন্তু, সদিচ্ছা থাকলে যে পরিষেবা স্বাভাবিক রাখা যায়, রেল এবং পুলিশের যৌথ ভূমিকা মঙ্গলবার সেই ইঙ্গিতই দিল। ফলে, শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখায় এ দিন ট্রেন চলল প্রায় পুরনো ছন্দে।

Advertisement

যে স্টেশনগুলিতে সোমবার অবরোধ এবং গণ্ডগোল হয়, সে সব জায়গায় এ দিন মোতায়েন করা হয়েছিল রেল ও জেলা পুলিশের পাশাপাশি আরপিএফ কর্মীদের। সকাল থেকেই বনগাঁ, গোবরডাঙা, মছলন্দপুর, হাবরা, অশোকনগর, দত্তপুকুর, বামনগাছির মতো স্টেশনে নিরাপত্তারক্ষীদের মোতায়েন করা হয়। এক একটি ট্রেন এই সব স্টেশনে যখন ঢুকেছে, তার আগেই প্ল্যাটফর্মের একেবারে সামনের দিকে চলে এসেছেন তাঁরা। ট্রেন চলে গেলেও তাঁরা সেখান থেকে একচুলও নড়েননি। এ দিনও ডাউন মাতৃভূমি লোকালে রীতিমতো কড়া নজরদারির ব্যবস্থা ছিল। প্রতিটি কামরাতেই নিরাপত্তারক্ষীরা ছিলেন। অভিযোগ, তাঁদের সামনেই কোনও কোনও স্টেশন থেকে পুরুষ যাত্রীরা ওই ট্রেনের বিভিন্ন কামারাতে উঠেছেন। পৌঁছেছেন গন্তব্যেও।

গত কাল অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলার পর তাঁদের সরাতে না পেরে এক পুলিশকর্মীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমরা এখানকার অবরোধ তুলে কী করব! আগের স্টেশনে অবরোধ থাকায় এই ট্রেন তো যেতে পারবে না। ওখানে উঠলেই আমরা এটা তুলে দেব!’’ সেই তিনিই এ দিন বলছেন, ‘‘আজ উপর মহলের নির্দেশ ছিল, কোথাও যেন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।’’

Advertisement


চলছে ভাঙচুর ও ইটবৃষ্টি।

সোমবার হাবরা স্টেশনে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগে রেলপুলিশ আট জনকে গ্রেফতার করেছে। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, সরকারি কর্মীদের মারধর করার মতো অভিযোগে ১০টি জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। ধৃতদের এ দিন বারাসত আদালতে হাজির করানো হবে। রেলপুলিশ সূত্রে খবর, তাঁদের বেশির ভাগেরই বাড়ি হাবরা থানার শ্রীনগর, শ্রীপুর, ৩ নম্বর রেলগেট, হাটথুবা এলাকায়। ধৃতদের আট দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানাবে রেলপুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে রেলপুলিশের অনুমান, ধৃতদের কেউই এই শাখার নিত্যযাত্রী নন। তা হলে তাঁরা কেন ভাঙচুর চালালেন? রেলপুলিশ জানিয়েছে, সেটাই তদন্ত করে দেখা হবে।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে নিত্যযাত্রীদের একাংশ একই প্রশ্ন তুলছেন। তাঁদের অনেকেই এই ভাঙচুর এবং অবরোধের বিরুদ্ধে। মছলন্দপুরের বাসিন্দা বিকাশ মোদক যেমন জানালেন, তিনি মাতৃভূমি লোকালে পুরুষ যাত্রীদের উঠতে দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু, তার মানে এমন ভাবে অবরোধ করে মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো ঠিক নয়। বড়বাজারে একটি সংস্থায় কাজ করা মধ্যবয়স্ক বিকাশবাবু বলেন, ‘‘এই নিয়ে দু’দিন অবরোধের জেরে কাজে যেতে পারলাম না। জানেন, পুজোর মুখে এই দু’দিনের বেতন কেটে নেবে কোম্পানি।’’

অবরোধের ঘোরতর বিরোধী অশোকনগরের দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ও। লালবাজারের কাছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। জানালেন, অবরোধের আশঙ্কা ছিল বলেই আগেভাগে সোমবার বাসে করে কলকাতার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। অশোকনগর থেকে প্রথমে বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে বারাসত, সেখান থেকে অন্য একটি বাসে বিধাননগর পৌঁছন। সেখান থেকে ট্রেন ধরে শিয়ালদহ। মাসিক টিকিট থাকতেও বেশি টাকা খরচ করে অফিস যেতে হচ্ছে বলে ক্ষুব্ধ তিনি। গোটা ঘটনার দায় রেলের উপর চাপিয়ে জানান, পরিযেবা পেতে রেলকে নিত্যযাত্রীরা অগ্রিম টাকা দেয়। ঘটনায় তাদের কোনও দায় কেন থাকবে না!

শুধু নিত্যযাত্রীরাই নন, রেল অবরোধের বিরুদ্ধে কিন্তু অনিয়মিত যাত্রীরাও। সংহতির ছাত্র সৌরভ দাস। দমদমের একটি সেন্টারে সপ্তাহে এক দিন টিউশন নিতে যায়। সরকারি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দেওয়া বছর পঁচিশের সৌরভ জানাল, আগামী রবিবার তার প্রাথমিকের টেট পরীক্ষায় বসার কথা। সেই নিয়েই সেন্টারে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির একটা পরীক্ষা ছিল। কিন্তু, অবরোধের জেরে সে সেন্টারে পৌঁছতে পারেনি। বনগাঁ, ঠাকুরনগর থেকেও তার অনেক সহপাঠী ওই দিন পৌঁছতে পারেনি। অথচ প্রস্তুতি কেমন হয়েছে সেটা বোঝার জন্য এই পরীক্ষা দেওয়াটা জরুরি ছিল বলে দাবি তার।


আতঙ্কে পালাচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা। সোমবার হাবরা স্টেশনে।

যে মাতৃভূমি লোকালকে কেন্দ্র করে এত কিছু, তার যাত্রীরাও কিন্তু অবরোধের বিরুদ্ধে। বনগাঁর বাসিন্দা শাশ্বতী চক্রবর্তী এ দিনের লেডিজ স্পেশ্যালে ছিলেন। জানালেন, সোমবারের ঘটনার পর রীতিমতো ঝুঁকি নিয়েই এই ট্রেনে উঠেছেন। তাঁর মতে, প্রতি দিন ট্রেনে চেপে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন কাজে যান। প্রতিবাদ, আন্দোলন তো থাকবেই। কিন্তু, তার অন্য পদ্ধতির কথা ভাবা উচিত। অবরোধ-মারামারি-ভাঙচুর সঠিক রাস্তা নয় বলেই মনে করেন তিনি।

দত্তপুকুরের বাসিন্দা সৌমেন মিত্রের মতে, একটি ট্রেনের তিনটি কামরায় পুরুষদের উঠতে দিলে বনগাঁ লোকালের ভিড় একবিন্দুও কমবে না। কয়েক’শ যাত্রীর কিঞ্চিত সুরাহা হতে পারে। সেই সুরাহার কথা ভেবে হাজার হাজার মানুষকে এ ভাবে ভোগান্তির চরম সীমায় পৌঁছে দেওয়ার বিরুদ্ধেই তিনি। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘হাফ প্যান্ট-বারমুডা পরে যাঁদের অবরোধ-গণ্ডগোল করতে দেখলাম, তাঁরা কি যাত্রী?’’

তবে, মাতৃভূমি লোকালের পাল্টা হিসেবে পিতৃভূমি লোকালেরও দাবি উঠেছে। বিভিন্ন স্টেশনে সে মর্মে একটি পোস্টারও নজরে এসেছে অনেকের। এমনকী, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতেও সেই পোস্টার ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে দুনিয়ার পুরুষকে এক হতে বলার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, আমরা পিতৃভূমি লোকাল চাই। নীচে দু’টি মোবাইল নম্বর। তারই একটি গোপাল মণ্ডলের। তাঁর দাবি, যদি মহিলাদের জন্য একটি বিশেষ ট্রেন থাকতে পারে, তবে পুরুষদের জন্যও একটি বিশেষ ট্রেন থাকা উচিত। সেই ট্রেনে শর্তসাপেক্ষে মহিলাদের উঠতে দেওয়া হতে পারে। তাঁর দাবি, বিশেষ ওই ট্রেনে সপরিবার যদি কোনও পুরুষ সফর করেন, তবে তিনি তাঁর স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে সেখানে উঠতে পারবেন। স্কুলপড়ুয়া এবং সিনিয়র সিটিজেন মহিলাদেরও ওই ট্রেনে উঠতে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘‘এই তালিকার বাইরে থাকা সক্ষম মহিলাদের উঠতে দেওয়া হবে না।’’ পশ্চিমবঙ্গ পুরুষ স্বাধিকার মঞ্চের সদস্য এবং পেশায় আইনজীবী গোপালবাবুর বাড়ি কলকাতার টালিগঞ্জে। তিনি ওই শাখার নিয়মিত যাত্রীও নন। মাঝে মাঝে দমদম থেকে শিয়ালদহ সফর করেন। এ দিন তিনি জানান, ওই পিতৃভূমি লোকালের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সৌন্দর্যায়নের দায়িত্ব তাঁরা নিতে রাজি আছেন। কিন্তু, এই সময়ে দাঁড়িয়ে লিঙ্গ বৈষম্য তাঁরা মেনে নেবেন না।

ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন