কুসংস্কার নয়, সচেতনতায় নির্মল হোক গ্রাম

বয়স অনুপাতে ছোটখাট চেহারা। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল পড়শিদের ঝাঁকাঝাকিতে রুগ্ণ শরীরের আরও আলুথালু অবস্থা। পরিজনদের একাংশের দাবি, কুঁড়ে ঘরের উঠোনের একধারে ছোট্ট পুজোর বেদির সামনে বসা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী শ্রীদেবীকে নাকি পেত্নি ধরেছে। খুড়তুতো দাদা নিমাই তাকে চেপে ধরে রেখে শুরু করেছেন ভূত তাড়ানোর নানা ওস্তাদি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তপন শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:০৩
Share:

চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে গিয়ে কিশোরীকে ঝাড়ফুঁক। ছবি:নিজস্ব চিত্র

বয়স অনুপাতে ছোটখাট চেহারা। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল পড়শিদের ঝাঁকাঝাকিতে রুগ্ণ শরীরের আরও আলুথালু অবস্থা। পরিজনদের একাংশের দাবি, কুঁড়ে ঘরের উঠোনের একধারে ছোট্ট পুজোর বেদির সামনে বসা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী শ্রীদেবীকে নাকি পেত্নি ধরেছে। খুড়তুতো দাদা নিমাই তাকে চেপে ধরে রেখে শুরু করেছেন ভূত তাড়ানোর নানা ওস্তাদি। দক্ষিণ দিনাজপুরের আদিবাসী অধ্যুষিত তপন ব্লকের আউটিনা অঞ্চলের লস্করহাট এলাকার সিপিএম পাড়ায় দু’দিন আগে মঙ্গলবার পড়ন্ত বেলায় বাসিন্দাদের মধ্যে তাই নিয়ে রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছে। সুনসান ভর দুপুরে এলাকার পুব দিকের এক পুকুর পাড়ের মাঠে শৌচকর্ম করে আসার পর থেকে ওই ছাত্রী অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে বলে তার বাবা মায়ের দাবি।

Advertisement

ওই কিশোরীকে পেত্নিতে ধরেছে খবরে এখন হাগড়ি পুকুর নামে সকলের কাছে পরিচিত ওই খোলামাঠের ঝোপঝাড় এড়িয়ে চলছেন বড়রাও। শৌচকর্ম করছেন নিজেদের বাড়িতেই। কারও বাড়িতে শৌচালয় না থাকলে, তিনি যাচ্ছেন অন্য বাড়ির শৌচালয়ে। ভূত তাড়াতে মেয়েটিকে চড় থাপ্পর মারা থেকে জুতো মুখে দৌড় করানোর নির্যাতনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে খোলা মাঠে মলমূত্র ত্যাগের ছবিটা বদলে গিয়েছে ওই এলাকায়। ভুত ধরবে ভয়ে এলাকার বড় থেকে কচিকাচারা ভুলেও পুকুরঘাটের পথ মারাচ্ছে না। যাদের বাড়িতে শৌচাগার নেই। সেইসব অভিভাবকেরাও রাতবিরেতে পড়শিদের শৌচাগার ব্যবহার শুরু করেছেন। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা হরেন বর্মন বলেন, খামোকা গায়ে পড়ে অশরীরী আত্মার ঝঞ্ঝাট কে পোহাবে?

চিকিৎসক ও বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, পেত্নির ভয়ে খোলা মাঠে শৌচকর্ম করার মতো বাজে অভ্যাস কেউ কেউ ছেড়েছেন বলে বিষয়টিকে বাহবা দিলে চলবে না। তাঁদের মতে, ভূত-পেত্নিতে বিশ্বাস করা ঘোরতর কুসংস্কার। তেমনই কুসংস্কার হল খোলা মাঠে শৌচকর্ম করা। তাঁদের কথায়, প্রশাসনের উচিত, এখনই দু’ঘরনের কুসংস্কারই রদ করতে উদ্যোগী হওয়া।

Advertisement

মিশন নির্মল বাংলা অভিযানে নেমে গ্রামগঞ্জে প্রশাসন থেকে পঞ্চায়েতের তরফে খোলা মাঠে শৌচকর্মে বন্ধে বাসিন্দাদের সচেতন করতে যখন ঘাম ছুটছে। সে সময় লস্করহাটের ওই এলাকার একশোর উপর কৃষিজীবী ও খেতমজুর পরিবারের বাসিন্দার মধ্যে ওই ছাত্রীর ভুতে ধরার মতো কুসংস্কারের জেরে মাঠঘাটে মলত্যাগের কুঅভ্যাস বন্ধের খবরে স্থানীয় আউটিনা পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষও উদ্যোগী হয়েছেন গ্রামে সচেতনতার প্রচার চালাতে। পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মাফিজার সরকার বলেন, গোটা গ্রাম পঞ্চায়েত ওডিএফ ঘোষণা হলেও এলাকায় এখনও ৩০০র মতো সুলভ শৌচাগার তৈরি বাকি। তাঁর বক্তব্য, ভুত বলে কিছু হয় না। তবে ওই কুসংস্কারের দৌলতে বাসিন্দাদের চোখ খুললে তো ভালই। বাকি শৌচাগার তৈরি সম্পূর্ণ করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে উপপ্রধানের দাবি।

পেত্নিতে ধরা বিষয়টি কী? নীলরতন সরকার হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ওমপ্রকাশ সিংহ বলেন, ‘‘যে কোনও ধরনের ভয় থেকেই এমন আচরণ দেখা যেতে পারে। একে বলে ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার। যে কোনও ডাক্তারই এই চিকিৎসা করতে পারেন। খুব সহজেই সমস্যা মেটানো যায়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’’ প্রশ্ন হল, ওই গ্রামে এমন ঘটনা ঘটলে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন কে? প্রশাসন অবশ্য দাবি করেছে, সব ধরনের সচেতনতা বাড়াতেই উদ্যোগী হবেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন