Rabindranagar Torture

অভাবে কৈশোর তলিয়ে যায় শোষণের অন্ধকূপে

অভিযুক্তেরা ধরা পড়লেও ছেলেটির খোঁজ নেই। পড়ে রয়েছে ভাইরাল হওয়া ভিডিয়ো। দৃশ্যগুলির সত্যতা এখনও তদন্তের আওতায়।

মেহেদি হেদায়েতুল্লা

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৫ ০৯:৪১
Share:

একটা ক্ষীণ, কাঁপা শরীর। উল্টো ঝুলে আছে-মাথা নীচে, পা উপরে। কাঁধে, পিঠে, ঘাড়ে নীলচে ক্ষত। হাত বাঁধা বৈদ্যুতিক তারে। মাটিতে পড়ে আছে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার যন্ত্রও। বছর পনেরোর সেই কিশোরের মুখে নিঃশব্দ কান্না। শুধু একটিই আর্তি বারবার, “মা…।”

এটা কোনও সিনেমার দৃশ্য নয়, থ্রিলারের ক্লাইম্যাক্সও নয়। এ আমাদের রাজ্যেরই এক কোণে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার রবীন্দ্রনগরের একটি কাপড় রংয়ের কারখানায় ঘটে যাওয়া বাস্তব। যে ছেলেটির উপরে এই নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছে, সে উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বয়স মাত্র পনেরো— যে বয়সে হাতে বই আর চোখে রঙিন স্বপ্ন থাকার কথা।

অভিযুক্তেরা ধরা পড়লেও ছেলেটির খোঁজ নেই। পড়ে রয়েছে ভাইরাল হওয়া ভিডিয়ো। দৃশ্যগুলির সত্যতা এখনও তদন্তের আওতায়। কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে, তা হৃদয়বিদারক। কারও কারও যুক্তি, “মজা করে ঝুলিয়ে রেখেছিল!” প্রশ্ন জাগে, উল্টো ঝুলিয়ে বৈদ্য়ুতিক শক দেওয়া কি আজকের সমাজে ‘মজা’ হয়ে উঠেছে? আমাদের রসবোধ কি এতটাই নিষ্ঠুর? ইসলামপুরের এই কিশোর ব্যতিক্রম নয়। চায়ের দোকান, গ্যারেজ, ইটভাটা, হোটেল— সর্বত্র শিশু শ্রমিক দেখা যায়। অথচ সরকারি পরিসংখ্যানে ‘শিশুশ্রম প্রায় নেই।’

ভারতীয় সংবিধান প্রত্যেক শিশুকে শিক্ষা ও সুরক্ষার অধিকার দিয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী ৬-১৪ বছর পর্যন্ত শিক্ষার অধিকার মৌলিক। আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নীচে কোনও শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই ১৫ বছরের ইসলামপুরের ওই কিশোর শুধু সামাজিক বা মানবিক নয়, আইনতও এক শিশু, যার প্রতি এই বর্বর আচরণ শুধু অমানবিক নয়, আইনবিরোধী দণ্ডযোগ্য অপরাধ।

কোভিড-পরবর্তী সময়ে এই ছবি আরও ভয়াবহ। বহু পরিবার কাজ হারিয়েছে, স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। হাজার হাজার শিশু-কিশোরের পড়াশোনার পথ থেমে গিয়েছে। সেই শূন্যতা পূরণ করেছে শ্রম। কেউ গ্যারেজে, কেউ কারখানায়, কেউ আবার ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে জীবিকার সন্ধানে। ইসলামপুরের ওই কিশোরের বাবার কথায়, “অভাব ছিল। কারখানার মালিক টাকা পাঠাবে বলেছিল। তাই ছেলেকে পাঠালাম।” এই ‘অভাব’ই তৈরি করে শোষণের ফাঁদ। আর শিশুরা, শিক্ষার আলো না পেয়ে, তলিয়ে যায় অন্ধকার গহ্বরে— যেখানে নেই অধিকার, নেই নিরাপত্তা, শুধু নিষ্ঠুর ব্যবহার। এই কিশোর শুধু দারিদ্রের শিকার নয়, সে আমাদের সমাজের নৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক। যে তাকে মারল, যে ভিডিয়ো তুলল, যে চুপ করে রইল, তারা প্রত্যেকেই এই নৃশংসতার নীরব সহযোগী।

প্রশ্ন জাগে, প্রশাসন, বিদ্যালয়, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি, চাইল্ডলাইন, শ্রম দফতর, কোথায় ছিল তারা? এই অবস্থায় শুধুই প্রতিবাদ নয়, প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ। দরিদ্র পরিবার চিহ্নিত করে শিশু সুরক্ষা সেল গঠন, শ্রমস্থলে নজরদারি, আইন প্রয়োগে কড়াকড়ি, স্কুলছুট শিশুদের ফেরানো এবং অভিভাবকদের সচেতনতায় গ্রামীণ কর্মশালা জরুরি। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি ও চাইল্ডলাইনের ভূমিকাও সক্রিয় করতে হবে। সর্বোপরি, ‘শিক্ষা একটি অধিকার’— এই বার্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। এই লড়াইয়ে সরকার, সমাজ ও প্রতিটি নাগরিককে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সাফল্য আসবে তখনই, যখন প্রতিটি শিশুর হাতে ফিরবে বই, আর চোখে ফিরবে রঙিন স্বপ্ন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন