হাততালি নিয়ে নাচ, শুরু হয় ‘ডেথ রেস’

মাঝরাতের শিলিগুড়িতে ক্রমশ যেন ‘ভেরি পপুলার’ হয়ে উঠছে ‘ডেথ-রেস!’‘শো’-এর নির্দিষ্ট কোনও ‘টাইম’ নেই। কোনওদিন রাত ১২টা, কোনওদিন ১টা। কোনওদিন আবার রাত ২টোয়। বিকট শব্দে বুলেট ট্রেনের গতিতে হাসমি চক থেকে মহাবীরস্থান ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে ছুটে যায় দেশবন্ধুপাড়ার দিকে।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:১১
Share:

গভীর রাতে সুনসান পথের নিস্তদ্ধতা ভেঙে ছুটে যায় মোটরবাইক। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

মাঝরাতের শিলিগুড়িতে ক্রমশ যেন ‘ভেরি পপুলার’ হয়ে উঠছে ‘ডেথ-রেস!’

Advertisement

‘শো’-এর নির্দিষ্ট কোনও ‘টাইম’ নেই। কোনওদিন রাত ১২টা, কোনওদিন ১টা। কোনওদিন আবার রাত ২টোয়। বিকট শব্দে বুলেট ট্রেনের গতিতে হাসমি চক থেকে মহাবীরস্থান ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে ছুটে যায় দেশবন্ধুপাড়ার দিকে। ‘ইউ টার্ন’ নিয়েই ফের উড়ালপুল দিয়ে প্রায় উড়ে হিলকার্ট রোডে আছড়ে পড়ে ছুটে যায় মহানন্দা সেতুর দিকে।

সেই ‘বাইক-গ্যাং’-এর আওয়াজ পেলেই ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠেন ফুটপাতের ভিক্ষুক, পথের ধারে শুয়ে থাকা কুকুরও। নজরদারিতে থাকা পুলিশ তাড়া করে পিছু নেওয়ার চেষ্টা করেও হাল ছাড়তে বাধ্য হয়। ‘‘উপায় কী! লাখ টাকার বাইকের সঙ্গে আশির দশকে কেনা ‘মরচে পড়া মুড়ির টিন’ কখনও পাল্লা দিতে পারে?’’—বিষণ্ণ সুরে এই খেদোক্তি প্রবীণ এক সাব ইন্সপেক্টরেরই!

Advertisement

হ্যাঁ, পুলিশ কমিশনার বা আইডি, এডিজিরা ঝাঁ চকচকে এসইউভি চড়লেও শিলিগুড়ির বেশির ভাগ থানার রাতের নজরদারির জন্য বরাদ্দ ‘ঘটরং-ঘটরং আগ্রাসী তেল খাওয়া জিপ’। পুলিশকর্মীরা অনেকে একান্ত আড্ডায় যে সব জিপকে মরচে পড়া মুড়ির টিনের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। সেই ‘মুড়ির টিনের’ উপরে তাই নিরাপত্তা নিয়ে ভরসা করতে পারেন না অনেক বাসিন্দাই।

শিলিগুড়ি থেকে মাটিগাড়া, দেশবন্ধুপাড়া থেকে এনজেপি, কাওয়াখালির মহানন্দা সেতু, প্রায় সর্বত্রই তাই রাত বাড়লেই ‘বাইক গ্যাং’-এর দাপটে জড়োসড়ো অনেকে। মহাবীরস্থানের গণেশ অগ্রবাল, ছবি প্রসাদের মতো প্রবীণ ব্যবসায়ীদের অনেকের অভিজ্ঞতাই ভয়ঙ্কর। গণেশবাবু শতাব্দী এক্সপ্রেস এনজেপিতে নেমে বাড়ি ফিরছিলেন নিজের গাড়িতে। দেশবন্ধুপাড়ার কাছে ফ্লাইওভার থেকে ঝড়ের গতিতে নেমে আসা তিনটে বাইকের সঙ্গে সংঘর্ষ ঠেকাতে তাঁর গাড়ি প্রায় উল্টে গিয়েছিল। কপালে চোট পেয়েছিলেন তিনি। চেনাজানা এক পুলিশ অফিসারকে অত রাতে ফোন করে বলেওছিলেন।

ছবি প্রসাদও উড়ালপুলের কাছে থাকেন। তিনিও মাঝরাতে ছাদে বসে দুরন্ত গতিতে বাইক রেস দেখে অনেকবার থানায় খবর দিয়েছেন বলে জানালেন। ছবিবাবুর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘‘কদিন আগে গোটা পাঁচেক ছেলেকে দেখলাম উড়ালপুলে ট্রাফিক পুলিশের শেডের সামনে দাঁড়াল। দুজনকে দেখলাম ‘ব্যাগপ্যাক’ থেকে বোতল বার করে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিল। অন্য ৩ জনকে দেখলাম সিগারেট ধরাতে। আচমকা সব গোল হয়ে দাঁড়িয়ে একে অন্যের হাতে তালি দিয়ে নাচতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরেই একজন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘নাউ লেটস স্টার্ট ডেথ রেস’।’’ এ টুকু বলে হাঁফাচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব বালি-পাথরের ব্যবসায়ী। ফের বললেন, ‘‘প্রাণ হাতে করে উড়ালপুলে ছোটাছুটি করতে গিয়ে কোনদিন বড় বিপদ ঘটবে, তখন হয়তো পুলিশের টনক নড়বে।’’

রাতের শিলিগুড়িতে বাইকের দাপাদাপির কথা অবশ্য পুলিশের কাছে নতুন কিছু নয়। শিলিগুড়ির ডিএসপি পদমর্য়াদার এক অফিসার জানান, হালে শিলিগুড়িতে অন্তত ৫টি বাইক-গ্যাং অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষত, ফি বছর পুজোর আগেই ওই গ্যাং দাপিয়ে বেড়ায়। বিকেল থেকে নানা এলাকায় দুরন্ত গতিতে ছুটে ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার ছক কষে তারা। গভীর রাত হলে নেশার ঘোরে ডেথ-রেস-এ মেতে ওঠে। পুলিশের অনুমান, মাস ছয়েকের মধ্যে মাঝরাতের পরে যে কটি বাইক দুর্ঘটনা উড়ালপুল বা ফাঁকা রাস্তায় হয়েছে তার বেশিরভাগই ‘রেস’-এর পরিণতি।

রাতের শিলিগুড়িতে নেশার আড্ডায় কান পাতলেই শোনা যাবে ‘বাইক-গ্যাং’-এর নানা কাহিনি। পানশালায় একবার মারপিটে জড়িয়ে যাওয়া বাইক-গ্যাংয়ের একাধিক যুবকের কাছ থেকে পুলিশ জেনেছিল, দুরন্ত গতিতে বাইক চালানোর জন্য তালিম দেওয়া হয় শিলিগুড়ি লাগোয়া ফাঁকা জায়গায়। পাকাপোক্ত হয়ে ওঠার পরে ৪-৫ জন মিলে গড়ে তোলে একটি গ্যাং। রাত গভীর হলেই যারা দাপিয়ে বেড়ায়। পুলিশের দাবি, বিচ্ছিন্ন ভাবে বিকট শব্দে এলাকা কাঁপিয়ে দুরন্ত গতিতে বাইক চালালেও এঁরা ‘অপরাধ-চক্র’ গড়ে তুলেছে বলে কোনও স্পষ্ট অভিযোগ নেই। তাই রাতের শহরে ‘ডেথ-রেস’ রুখবে কে!

তাছাড়া রাতে এমন সব কারবার হয় যে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পৌঁছয় না কোথাও। যেমন, রাত নামলেই শহরের কিছু হোটেল, পানশালায় ‘সফট-টয়’-এর কারবার শুরু হয়ে যায়। কোথাও ‘থ্রি-চিয়ার্স’-এর রমরমা, কোথাও আবার সিঙ্গিং-বার, ডিস্কোর আশেপাশে ‘খেলনা’র দখল নিয়ে হাতাহাতি, গুলি, ছুরি উঁচিয়ে তেড়ে যাওয়া, অ্যাসিড ছোড়া।

‘সফট-টয়’, ‘খেলনা’ বা ‘থ্রি-চিয়ার্স’-এর ব্যাপারাটা তা জানলে তাজ্জব বনে যেতে হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন