সার্কাস! নলেন গুড়ের মতোই শীতের আর এক প্রধান আকর্ষণ!
তখন বয়স কত হবে! দশ-বারো! একটি রিকশায় মাইক বাঁধা। গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলছে রিকশা। কানে ভেসে আসছে— ‘আসুন! আসুন! আসুন! আর মাত্র সাত দিন! সার্কাস! সার্কাস! সার্কাস!’ লিফলেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে হাতে হাতে। মায়ের হাত ধরে সেই সার্কাস দেখেছিলাম এক শীতের রাতে। শরীরে গরম জামাকাপড় ছিল। তার পরেও মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম বারে বারে।
কেন জড়িয়ে ধরেছিলাম? এক, ভয়ে। দুই, আনন্দে। কেমন সেই ভয়? সিংহের গর্জনের ভয়! হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে যাওয়া বাঘের চাহনিতে। হাতি দেখে অবশ্য অন্য রকম আনন্দ হয়েছিল। আর আনন্দ? টিয়া-কাকাতুয়ার ডাকে আনন্দে মেতে উঠেছিলাম! কী সুন্দর নাম ধরে ধরে ডাকছিল! ‘ওই অসীম! ওই অসীম’! ওই প্রথম শুনেছিলাম পাখির কথা। বলতে বলতে খানিকটা আনমনা হয়ে পড়েন এক প্রৌঢ়া। এখন শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। সকালের কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারদিক। শিশিরে ভিজে উঠছে সকালের পথচারীরা। কানে ভেসে আসছে সেই মাইকের শব্দ— ‘সার্কাস! সার্কাস! সার্কাস!’
ময়ূরের পেখমের মতোই আনন্দে নেচে উঠছে মন। এই প্রজন্ম ছুটছে সার্কাস দেখতে। অবশ্য এখন সেই বাঘ নেই, সিংহ নেই, হাতি নেই, নেই টিয়া-কাকাতুয়ারাও। রয়েছে প্রশিক্ষিত কুকুর। রয়েছে জিমন্যাস্টিককে পারদর্শী রুশ বা আফ্রিকার মেয়েরা। তাঁদের খেলা দেখেই আনন্দে ঘরে ফিরছেন সবাই।
শীতের প্রতি একটা ভালবাসা বোধ হয় প্রত্যেকেরই আছে। গরমে ক্লান্ত হতে হতে একটা সময় অপেক্ষা শুরু হয় শীতের। শীত মানে এক আনন্দ। জীবন যেমন কষ্ট-আনন্দ তৈরি। তেমনই এই ঋতু। শীত মানেই নতুন জামা, নতুন সোয়েটার, জ্যাকেট থেকে রংবাহারি পোশাক। লেপের ওম। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মন উঠতে না চাওয়া। শীতেই পিঠে। সবাই মিলে সেই আনন্দে মেতে ওঠা। শীতেই অনুষ্ঠানের জোয়ার। যাত্রা-নাটক থেকে পিকনিক। সবাই মিলে বেরিয়ে পরা। তার পর চুটিয়ে প্রকৃতির স্বাদ নিয়ে সায়াহ্নে ঘরে ফেরা। সেই শীতেই বসে সার্কাস। যার সঙ্গে গ্রাম-শহর, পাহাড়-তরাই-সমুদ্র সব অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে। সবারই ছোটবেলা একবার হলেও সেই চার দেওয়ালের ভিতর কিছু সময়ের সঙ্গে আটকে পড়ে। সেখানেই পরিচয় হয়, ক্লাউনের সঙ্গে। সেখানেই মৃত্যুকূপে বাইক-গাড়ি গিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তরুণ-তরুণীকে। এক আশ্চর্য় জগত! ভবানীপ্রসাদ মজুমদার লিখেছেন, ‘মার্কাস স্কোয়ারেতে বসেছিল সার্কাস/উঁচু উঁচু টিন দিয়ে ঘেরা ছিল চারপাশ!/একদিন মাঝরাতে সেই বেড়া লাফিয়ে/ডোরা কাটা কেঁদো বাঘ কলকাতা কাঁপিয়ে’।
উত্তরে কেমন হচ্ছে সার্কাস?
কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার
রাসমেলার সঙ্গে কোচবিহারের সার্কাসের নাম জড়িয়ে আছে বহু বছর ধরে। রাসমেলা মানেই শীতের শুরু হয়ে গিয়েছে তখন। কাতারে কাতারে মানুষ চারদিক থেকে ভিড় করছেন মেলায়। মেলার মাঠের একপাশে বসেছে সার্কাস। সারাদিনে তিনটি শো চলছে। দুপুর-বিকেল ও রাতের ওই শো চলে প্রায় তিন ঘণ্টা করে।
সকাল থেকেই মানুষের ভিড় জমে যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হয়। তার পর সার্কাস দেখা। এবারেও অ্যাম্পায়ার সার্কাস এসেছিল মেলায়। ২০ দিন ধরে ওই সার্কাস চলেছে। ওই সার্কাসে এবারে দর্শকদের মন কেড়েছিল কুকুর। একসময় বন্যজন্তু নিয়ে হাজির হতো সার্কাস দল। এখন তা বন্ধ রয়েছে। তাই কুকুরকে প্রশিক্ষিত করে নিয়ে এসেছে। কুকুর কখনও সাইকেল চালায়, তো কখনও ফুটবল খেলে। আবার রিং মাস্টারের কথায় যেন রোবট হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। রাসমেলা ছাড়াও সীমান্ত গ্রাম থেকে শহরতলির নানা জায়গায় শীতের সময় ধরে ওই সার্কাস চলতে থাকে।
ধলুয়াবাড়ির শিবের মেলাতেও কখনও কখনও সার্কাস দল আসে। তবে আগের তুলনায় অনেকটা ছোট সার্কাস দল এখন দেখা যায়। আলিপুরদুয়ারেও সার্কাস নিয়ে উদ্মাদনা রয়েছে তুঙ্গে। এবারে শীতের শুরুরে হ্যামিল্টনগঞ্জের কালীমেলায় বসেছিল সার্কাসের আসর। এর পরে শামুকতলার, ধানহাটি কালীবাড়িতে বসেছিল পনেরো দিন ধরে। ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে ছিল সার্কাসের টিকিট। তাতেও অবশ্য মানুষের ঢল কমেনি। ছোটরা তো বটেই, বয়স্করাও ভিড় করেছেন সেই সার্কাসে।
জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি
এক দিকে জঙ্গল ঘেরা প্রকৃতি। আরেক দিকে পাহাড়ের হাতছানি। ধূ ধূ বিস্তৃত মাঠের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকে চা বাগান। সেই এক প্রকৃতির মধ্যেও সার্কাসের টান কমেনি আজও।
শহর শিলিগুড়িতেই বসে সার্কাসের আসর। একসময় বর্ধমান রোড লাগোয়া রেলের মাঠেই বসত সার্কাসের আসর। সূর্যসেন পার্কের পাশে মহানন্দা নদীর তীরেও বেশ জমাটি সার্কাসের আসর বসত। আবার জাতীয় সড়ক লাগোয়া ইন্দিরা গাঁধী ময়দানেও সার্কাসের আসর বসে। ওই সার্কাসের শুধু শিলিগুড়ি নয়, সিকিম, দার্জিলিং পাহাড়ের মানুষেরাও সামিল হতেন। সকাল থেকেই সবাই পাহাড় থেকে নেমে আসতে শুরু করেন। এক সময় সার্কাস ঘিরে থিকথিকে ভিড় হয়ে যায়। কার্যত মেলা বসে যেত সার্কাসের প্রাঙ্গণ জুড়ে।
সেনাবাহিনী, বিএসএফ, সিআরপিএফ, এসএসবি’র ক্যাম্প রয়েছে শিলিগুড়ি লাগোয়া এলাকায়। সেই ক্যাম্প থেকে পরিবার নিয়ে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান-অফিসারেরাও সার্কাসের দেখতে হাজির হন।
বর্তমানে শিলিগুড়ির শহরের পরিধি বাড়ছে। এবারে সার্কাসের আসর বসেছে মাটিগাড়ার বিজ্ঞানকেন্দ্রের মাঠে। একই ভাবে জলপাইগুড়ির শান্তিপাড়ার মাঠ, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ফালাকাটাতেও বসে সার্কাসের আসর। সময় অনেক বদলে গিয়েছে। মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত। তবু কিছু মানুষ এখনও আসেন সার্কাসে।
উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ
বন্য জন্তু নেই। নেই পাখি। তাই সার্কাসের প্রতি টান যেন মানুষের কমে আসছে ক্রমশ। এই একটা কথা বারে বারে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, অনেক নামকরা সার্কাসের দল হারিয়ে গিয়েছে। যে সব সার্কাসের দল এখনও আসছে, খেলা দেখাচ্ছে, তাদের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। সে সবই যেন উঠে এসেছে ইতিহাস-আবৃত মালদহ থেকে দুই দিনাজপুরে।
মালদহের রামকৃষ্ণ মিশনের মাঠের একবছর আগে একটি সার্কাসের দল এসেছিল। তারও আগে ওই মাঠ এবং ডিএসএ স্টেডিয়াম সংলগ্ন মাঠে সার্কাসের দেখা মিলত। এখন সে সব মালদহের আরেক ইতিহাস হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
একই ছবি দুই দিনাজপুরেও। বালুরঘাটে শেষ সার্কাসের শো হয়েছিল অন্ততপক্ষে পাঁচ বছর আগে। রায়গঞ্জে ওই সময় দশ বছরের। আবার হেমতাবাদের মতো গ্রামেও পাঁচ বছর আগে সার্কাস তাঁবু ফেলে। তাই শীতের আনন্দে সার্কাসের সঙ্গে মেতে ওঠা যেন একটু ফিকে হয়ে উঠতে শুরু করেছে। অবশ্য এ সবের মধ্যেই দর্শকরা আশাবাদী যে, শীত আর সার্কাস জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। শিশুরা আজও সার্কাসে বুঁদ। তাই শীত যতদিন থাকবে, থাকবে সার্কাসও।