দিল্লি থেকে বাগডোগরা হয়ে কালিয়াগঞ্জে। ছবি: অভিজিৎ পাল।
নিজের খাসতালুকে দুর্গ দখলেই রাখলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ দীপা দাশমুন্সি।
২০০৯ সালের কালিয়াগঞ্জ পুরসভা নির্বাচনে ১৩টি ওয়ার্ড দখল করেছিল কংগ্রেস। ওই বছর তৃণমূল ও সিপিএম দুটি করে ওয়ার্ড দখল করে। এ বছর সিপিএমের একটি ওয়ার্ড কমলেও বিজেপি অবশ্য কংগ্রেসের হাত থেকে একটি ওয়ার্ড ছিনিয়ে নিয়েছে। কালিয়াগঞ্জের পলিটেকনিক কলেজের গণনাকেন্দ্র থেকে এদিন শহরের একের পর এক ওয়ার্ডে কংগ্রেস প্রার্থীদের জয়ের কথা ঘোষণা শুরু হতেই অবাক হয়ে যান দলের নেতা ও কর্মীরা। এক সময়ে কালিয়াগঞ্জ পুরসভার বিদায়ী চেয়ারম্যান তথা ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী অরুণ দে সরকার ও তাঁর স্ত্রী তথা ১ নম্বর ওয়ার্ডের জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী মায়া দে সরকারকে প্রকাশ্যেই বলতে শোনা যায়, ‘‘দল ভাল ফল করবে আশা করেছিলাম। কিন্তু ১৫টি আসনে কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়ী হবে, তা ভাবতে পারিনি।’’
২০০৯ সালের পুরসভা নির্বাচনে ১২ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ড তৃণমূল ও ৯ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ড সিপিএম দখল করেছিল। এবছর ১২, ১৩ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড কংগ্রেস তৃণমূল ও সিপিএমের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেও ১০ নম্বর ওয়ার্ডটি সিপিএমের একমাত্র জয়ী প্রার্থী জ্ঞানেন্দ্রশঙ্কর মজুমদার নিজের দখলে রেখেছেন। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কংগ্রেস কাউন্সিলর অমিত দেবগুপ্ত নির্বাচনের মুখে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ওই ওয়ার্ড থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পেয়েছেন। তাই ৭ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ড বাদে বাকি সবগুলি ওয়ার্ডেই কংগ্রেসের দখলে গিয়েছে।
রায়গঞ্জের কংগ্রেস প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ দীপা বলেন, ‘‘কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের সন্ত্রাস, হুমকি ও তোলাবাজির লড়াইয়ের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের শান্তির লড়াই জয়ী হয়েছে। গত দুই দশকের কংগ্রেস পরিচালিত কালিয়াগঞ্জ পুরসভার ধারাবাহিক উন্নয়নমূলক কাজকর্মের প্রতি বাসিন্দারা আস্থা রেখে তৃণমূলকে প্রত্যাখ্যান করে মুছে দিয়েছেন। গত লোকসভা নির্বাচনের মতো তৃণমূল হাজারো ষড়যন্ত্র করেও কংগ্রেসকে হারাতে পারেনি।’’
উত্তর দিনাজপুর জেলা কংগ্রেস সভাপতি মোহিত সেনগুপ্তের অভিযোগ, তৃণমূল গত প্রায় একমাস ধরে কালিয়াগঞ্জ ও ইসলামপুর পুরসভা দখলের জন্য কখনও বাসিন্দাদের মধ্যে টাকা বিলিয়েছে, আবার কখনও দুষ্কৃতীদের দিয়ে বাসিন্দাদের নানাভাবে হুমকি দিয়েছে! তাঁর কথায়, শাসকদলের চোখরাঙানি ও প্রতিকূলতা সত্বেও কালিয়াগঞ্জ ও ইসলামপুরের বাসিন্দারা ফের কংগ্রেসকে দুটি পুরসভা উপহার দেওয়ায়, এটাই প্রমাণিত হল যে উন্নয়নের স্বার্থে কংগ্রেস ও বাসিন্দারা পরস্পরের পাশে রয়েছেন।
জেলা তৃণমূল সভাপতি অমল আচার্যের দাবি, ‘‘অতীতের মতো এ বছরও কংগ্রেস সিপিএম ও বিজেপির সঙ্গে লেনদেনের গোপন বোঝাপড়া করে চাপা সন্ত্রাস চালিয়ে ও টাকার জোরে কালিয়াগঞ্জ ও ইসলামপুর পুরসভা দখল করেছে।’’ কিন্তু, তৃণমূলের অন্দরের খবর, অমলবাবুর বিরুদ্ধেও এই পুরভোটে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার না করার অভিযোগ উঠেছে।
বামেদের বিপর্যয় হল কেন? সিপিএমের জেলা সম্পাদক অপূর্ব পাল বলেন, ‘‘সাংগঠনিক দুর্বলতা ও বাসিন্দাদের পাশে থাকার প্রবণতা কমে যাওয়ায় কালিয়াগঞ্জ ও ইসলামপুরে বামফ্রন্টের ফল খারাপ হয়েছে। ফলাফলের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দলকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি।’’
বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর চক্রবর্তীর দাবি, তৃণমূলের সন্ত্রাস সত্ত্বেও প্রাপ্ত আসনের নিরিখে কালিয়াগঞ্জ ও ইসলামপুর পুরসভায় মোট চারটি আসন পেয়ে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। ইসলামপুরে বিজয়ী এক নির্দল প্রার্থী বিজেপিকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘জেলায় দলের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে এই ফল আমাদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছি।’’
এদিন সকাল ৮টা থেকে কালিয়াগঞ্জ পলিটেকনিক কলেজে পুরসভা নির্বাচনের গণনা শুরু হয়। পলিটেকনিক কলেজ থেকে ২০০ মিটার দূরের একটি মাঠে কংগ্রেসের কয়েক হাজার কর্মী সমর্থক ভিড় জমান। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা রায়গঞ্জের বিধায়ক মোহিতবাবু, কালিয়াগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক প্রমথনাথ রায়, দলের দুই জেলা সাধারণ সম্পাদক পবিত্র চন্দ, সন্দীপ বিশ্বাস, রায়গঞ্জ লোকসভা যুব কংগ্রেস কমিটির সহকারী সভাপতি তুষার গুহ প্রমুখ।
ওই মাঠেরই আরেকটি কোনে তৃণমূলের কয়েকশো কর্মী জড়ো হলেও ফল খারাপের আশঙ্কা করে বড় মাপের কোনও নেতা সেখানে যাননি। সকাল ৯টা নাগাদ একের পর এক ওয়ার্ডে কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন বলে জানাজানি হতেই তৃণমূলের কর্মী সমর্থকেরা মাঠ ছেড়ে চলে যান। তবে ওই মাঠ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সিপিএমের শিবিরে অবশ্য এদিন শুরু থেকেই দলীয় কর্মী সমর্থকেরা বসে ফলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
এদিন কালিয়াগঞ্জের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী অনিন্দিতা বসু পরাজিত হতেই গণনাকেন্দ্রেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর স্বামী তথা তাঁর গণনা এজেন্ট জয়ন্তবাবু। একই সময়ে ১০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী তথা কালিয়াগঞ্জ শহর তৃণমূল সভাপতি জয়ন্ত সাহা পরাজিত হতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর গণনা এজেন্ট তথা টিএমসিপির কালিয়াগঞ্জ শহর কমিটির সহকারী সভাপতি বঙ্কিম সরকার। পুলিশ ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে তাঁদের অ্যাম্বুল্যান্সে করে কালিয়াগঞ্জ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন দলের কর্মী সমর্থকেরা।
কংগ্রেসের কর্মী সমর্থকরা জানান, রায়গঞ্জের প্রাক্তন সাংসদ দীপা নিয়মিত কালিয়াগঞ্জে দলের কর্মসূচিতে যোগ দেন। তা ছাড়া দীপার নির্দেশে কাউন্সিলররা কোনও রং বিচার না করে সব সময় বাসিন্দাদের পাশে থাকেন। তাঁরা নিয়মিত বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাসিন্দাদের খোঁজখবর রাখেন ও তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেন। বাসিন্দাদের অনেকেরই ধারণা, তাই দু’দশক ধরে পুরসভায় ক্ষমতাসীন কংগ্রসকে আরও ৫ বছর বোর্ড চালানোর ভার দিয়েছে কালিয়াগঞ্জ।