হয়নি এইমস। উত্তর দিনাজপুরের পানিশালার জমি ফাঁকা পড়ে।—নিজস্ব চিত্র
রাজ্যে নতুন সরকারের মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণে বাকি আর কয়েক ঘণ্টা। রাজ্যের সম্ভাব্য মন্ত্রিসভা কেমন হবে তা জানতে উৎসুক কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার। নেতা-নেত্রীদের অনুগামীদের মধ্যে ‘দাদা-দিদি’রা মন্ত্রী হবেন বলে প্রত্যাশা বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা বাড়ছে সাধারণ বাসিন্দাদেরও। উত্তরবঙ্গে বড় শিল্পের আশা রয়েছে সকলেরই। রয়েছে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের আশা। কিন্তু সেই সঙ্গে রয়েছে আরও অনেক আকাঙ্ক্ষাও। যা আবর্তিত হচ্ছে হেঁসেলের খরচ কমা, কর্মসংস্থান, যাতায়াত, আয় বৃদ্ধি, ছোটদের পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি এমনই নানা গৃহস্থালি-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। প্রাথমিক স্কুল থেকে শিল্প কারখানা যাবতীয় ক্ষেত্র নিয়েই প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন বাসিন্দারা। শোনা গিয়েছে, বেশ কিছু ঘোষণা নিয়ে আশা ভঙ্গের কথাও। তারই মধ্যে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বাছাই করা কিছু প্রত্যাশা-দাবি তুলে ধরা হল।
চাই মেডিক্যাল কলেজ
ফি বছর রাজ্য বাজেটের আগে কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি জেলার বাসিন্দাদের অনেকেই মেডিক্যাল কলেজ চালুর ঘোষণা শুনতে উৎসুক হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার আগে জ্যাকসন মেডিকেল স্কুল ছিল জলপাইগুড়িতে। স্কুলের পাঠ্যক্রম শেষে ‘এলএমএফ’ ডিগ্রি দেওয়া হত পড়ুয়াদের। এক সময় এই স্কুলই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে চিকিৎসকের চাহিদা পূরণ করত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকেই একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ চালুর দাবি ওঠে জলপাইগুড়িতে। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরি হয়েছে জলপাইগুড়িতে। জেলা সদর এবং লাগোয়া এলাকার বাসিন্দারা প্রত্যাশা করছেন, এ বার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস জলপাইগুড়িতে হোক। নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে কোচবিহারে। সেখানেও দাবি, চিকিৎসার যে কোনও প্রয়োজনে ছুটতে হয় শিলিগুড়িতে। জেলায় বিমানবন্দর রয়েছে, দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, জেলাবাসীর দাবি মেডিক্যাল কলেজ তৈরির যাবতীয় পরিকাঠামো রয়েছে। ঘোষণাটুকুরই যা অপেক্ষা!
এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল
সাত বছর আগের কথা। রায়গঞ্জের পানিশালাতে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৮২৩ কোটি টাকা বরাদ্দের অনুমোদনও দেওয়া হয়। কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়, হাসপাতাল তৈরির জন্য রাজ্য সরকারকে বিনা মূল্যে জমি দিতে হবে। ২০১২ সালের মধ্যে হাসপাতাল তৈরির কাজ শেষ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়। জেলা প্রশাসন এরপর রায়গঞ্জের পানিশালায় ১২৫ একর জমি চিহ্নিত করে। প্রক্রিয়া শুরু করতেই বিধানসভা ভোট ঘোষণা হয়ে যায়। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আটকে যায়। মাস কয়েক আগে রাজ্য সরকার ওই হাসপাতাল তৈরির জন্য নদিয়ার কল্যাণীতে জমি অধিগ্রহণ করে কেন্দ্রকে হস্তান্তর করে। বাসিন্দাদের প্রত্যাশা রায়গঞ্জে অথবা উত্তরবঙ্গেই এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরি হোক।
আরও কলেজ হোক
গত কয়েক বছরে মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত করা হয়েছে অনেক স্কুলকে। যদিও, সেই অনুপাতে কলেজের আসন সংখ্যা বাড়েনি, নতুন কলেজও খুব একটা বেশি তৈরি হয়নি বলে শিক্ষাবিদদের মতামত। তার ফলে স্কুল শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার মধ্যে ব্যবধান রয়েই গিয়েছে। জেলাগুলির প্রত্যন্ত এলাকাতেও উচ্চশিক্ষার চাহিদা বেড়েছে। শিক্ষাবিদদের এই দাবির যৌক্তিকতা টের পাওয়া যায় উত্তরের জেলা শহর থেকে গ্রামে কলেজ তৈরির দাবিতে। মালদহের মোথাবাড়ি, সুজাপুর, হবিবপুর এবং রতুয়াতে নতুন ডিগ্রি কলেজের দাবি উঠেছে। জেলাতে একটি মহিলা কলেজের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। আরও একটি মহিলা কলেজে তৈরির দাবি উঠেছে। উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ ও গোয়ালপোখরের পড়ুয়াদের উচ্চশিক্ষার প্রায় শ’কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। দুই ব্লকেই কলেজ তৈরির দাবি রয়েছে বাসিন্দাদের। কোচবিহার জেলায় আইন পড়ার কোনও সুয়োগ নেই, জেলায় একটি আইন কলেজ চাইছেন শিক্ষাবিদ এবং পড়ুয়ারা। দিনহাটা, সিতাইয়ে সাধারণ কলেজ এবং তুফানগঞ্জে মহিলা কলেজেরও দাবি রয়েছে। রাজ্যের নতুন সরকার কলেজের অভাব পূরণ করবেন, এই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের।
হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়
ডুয়ার্সের চা বলয়ে হিন্দি স্কুল-কলেজ তৈরি হলেও এখনও পর্যন্ত কোনও হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় পড়ুয়াদের সমস্যায় পড়তে হয় বলে অভিযোগ। এ বার রাজ্যের নতুন সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা পূর্ণাঙ্গ হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের। ডুয়ার্সের চা বলয়ে হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হলে চা বলয়ে শিক্ষার মান যেমন বাড়বে, তেমনই শিক্ষার সার্বিক প্রসারও হবে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। এখনও পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে চা বলয়ের প্রাপ্তি বানারহাটের হিন্দি কলেজ। কিন্তু শুধু একটি কলেজ নয়, পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হলেই ডুয়ার্সে শিক্ষার বিকাশ ঘটবে। সেই সঙ্গে সাদ্রি ভাষার বিকাশের জন্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বলেও মত অনেকের।
ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল
উচ্চ শিক্ষা এবং ভবিষ্যতে বেসরকারি চাকরি ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে পড়ুয়া এবং অভিভাবকদের অনেকেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দিকে ঝুঁকছেন। শিক্ষাবিদরা জানিয়েছেন, এই প্রবণতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তবে ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলের একাংশে পঠনপাঠন খরচ জোগাড় করা মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির সম্ভব হয় না। সরকারি বা আধা সরকারি স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকলে, এই সমস্যা থাকে না। সে কারণেই, কোচবিহারের অভিভাবকদের দাবি, দ্রুত জেলায় অন্তত একটি হলেও রাজ্যের বোর্ডের স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা হোক। জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্সের অভিভাবকদের প্রত্যাশাও তাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব
গত বছর ১০টি বিষয়ে স্নাতকোত্তরের পঠপাঠন শুরু হয়েছে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বছর অতিরিক্ত আরও ১২ বিষয়ে স্নাতকোত্তরে পঠনপাঠন শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকাঠামোগত সমস্যা অনেক। বিধানসভা ভোটের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে রাজ্য সরকারের কাছে ১০ তলার দু’টি ভবন তৈরির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ওই ভবনগুলিতে ক্লাসরুম, বিভিন্ন বিভাগ ও প্রশাসনিক কার্যালয় তৈরি হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়াও সম্প্রসারিত ভবন তৈরির জন্য ২০ একর জমি দেওয়া, শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে ১০০টি পদ সৃষ্টি, মেডিক্যাল সেন্টার, গ্রন্থাগার তৈরি সহ সার্বিক পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পরিকাঠামো তৈরি না হলে সুষ্ঠু পঠনপাঠন বজায় রাখা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশা, নতুন সরকার তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করবে। বালুরঘাটেও একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর দাবি জেলাবাসীর দীর্ঘ দিনের। সেই আশাতেও বুক বাঁধছেন জেলাবাসী।
ক্যান্সার চিকিৎসা
ক্যান্সারের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য পরিকাঠামো গড়ে তোলার দাবি উঠেছে। বর্তমানে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও জটিল পরিস্থিতিতে সেখান থেকে রেফার করে দেওয়া হয়। যথাযথ চিকিৎসা মেলে না বলে রোগীদের অনেকেই অভিযোগ তোলেন। যাঁদের আর্থিক অবস্থা ভাল, তাঁদের অনেকেই ভিন রাজ্যে গিয়ে চিকিৎসা করান। ক্যান্সারের উন্নত চিকিৎসার জন্য তাই সরকারি পরিকাঠামো গড়ে তোলার দাবি রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরেই। বর্তমানে রেডিও থেরাপি বিভাগের অধীনেই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে চলছে ক্যান্সারের চিকিৎসা। কিন্তু রোগ নির্ণয়, পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য আলাদা বিভাগ থাকলে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষেরই একাংশ। বর্তমানে কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি, রে দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে ব্যাকি থেরাপির মতো বিভিন্ন উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা চালু হলে রোগীরা উপকৃত হবেন বলে জানা গিয়েছে।
সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল
ঘোষণা হলেও মালদহের চাঁচলের সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল এখনও তৈরি হয়নি। রায়গঞ্জ ও ইসলামপুরে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে তো চলছেই। কবে কাজ শেষ হবে, কবে ইন্ডোর পরিষেবা মিলতে শুরু করবে, তাই এখন প্রশ্নের মুখে। কোচবিহারের তুফানগঞ্জে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির প্রকল্প সরকারি অনুমোদন পেলেও, কবে কাজ কবে শুরু হবে, তা জানেন না জেলার স্বাস্থ্য কর্তারা। দু’বছরের মধ্যে জলপাইগুড়ির সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ভবন নির্মাণ শেষ হয়ে কাজ শুরু হয়ে যাবে বলে জানানো হয়েছিল। দু’বছর পেরিয়ে গিয়েছে, এখনও শহরের টিবি হাসপাতাল পাড়ার নতুন তৈরি ভবনে চিকিৎসা শুরু হয়নি। বছর দেড়েক আগে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে একটি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হবে বলে ঘোষণা হয়েছিল। ভবন তৈরির জন্য জমি চিহ্নিত হয়েছে, অর্থও বরাদ্দ হয়েছে। যদিও একটি ইটও গাঁথা হয়নি। দক্ষিণ দিনাজপুরে চিকিৎসা ব্যবস্থা বলতে এ জেলায় সরকারি হাসপাতালই ভরসা। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে বালুরঘাট এবং গঙ্গারামপুরে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের সুদৃশ্য ভবন থেকে পরিকাঠামো তৈরি হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা এখনও চালু হয়নি।
ট্রমা সেন্টার
জাতীয় সড়কের পাশে যে কোনও হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজে ট্রমা সেন্টার থাকে। সেই মতো মালদহ এবং উত্তরবঙ্গ দুই মেডিক্যাল কলেজেই ট্রমা সেন্টার চালু করার কথা ছিল। মালদহ জেলায় প্রায়ই পথ দুর্ঘটনা ঘটে। ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট না থাকায় রোগীদের রেফার করা হয় কলকাতায়। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ট্রমা সেন্টার গড়ার কাজ শুরুর কথা ছিল ২০০৯ সালে। কাজ শুরু হয় দুই বছর বাদে। ভবনের পরিকাঠামো গড়ে উঠলেও আর কিছু হয়নি। যন্ত্রাংশ কেনা, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের জন্য বরাদ্দ মিলছিল না। সম্প্রতি ওই কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। তবে এখনও ঢিমেতালে কাজ চলছে বলে অভিযোগ। ঘোষণা হলেও ট্রমা কেয়ার সেন্টার হয়নি আলিপুরদুয়ারেও।