জঙ্গলে ঢেকে যাচ্ছে জলাভূমি

এটাই কি একটি প্রাচীন দিঘি? চেনা যাচ্ছে না। কারণ, জঙ্গল দিয়ে ঢাকা পড়ে গেছে গোটা দিঘিটা। রাজবাড়ির উত্তর দিকে রাজবাড়িপাড়া এবং ইন্দিরা কলোনির সংযোগস্থলে অবস্থিত এই দিঘিটির বয়স কত তা কেউ বলতে পারেনি। কেউ বলছেন রাজা জয়ন্তদেবের আমলে(১৭৯৩-১৮০০) দিঘিটি খনন করা হয়েছিল।

Advertisement

রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৫ ০৩:২৯
Share:

জঙ্গলে ভরে গিয়েছে রাজবাড়ির একটি পুকুর। দখল হয়ে যাচ্ছে আশপাশের জায়গাও। নিজস্ব চিত্র।

এটাই কি একটি প্রাচীন দিঘি? চেনা যাচ্ছে না। কারণ, জঙ্গল দিয়ে ঢাকা পড়ে গেছে গোটা দিঘিটা। রাজবাড়ির উত্তর দিকে রাজবাড়িপাড়া এবং ইন্দিরা কলোনির সংযোগস্থলে অবস্থিত এই দিঘিটির বয়স কত তা কেউ বলতে পারেনি।

Advertisement

কেউ বলছেন রাজা জয়ন্তদেবের আমলে(১৭৯৩-১৮০০) দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। আবার কেউ বলছেন রাজা সর্বদেব (১৮০০-১৮৪০) দিঘিটি খনন করেছিলেন। কমপক্ষে ৫ বিঘা জায়গা জুড়ে পড়ে আছে এই দিঘিটি। জল আছে প্রচুর। তবু কেমন করে যেন আগাছায় ঢাকা পড়ে গেছে এই দিঘিটি। মাটি থেকে অনেক নিচে জল। তার ওপর আগাছা। পুকুরটির পশ্চিম দিকের একটা অংশ ভরাট করে দখল হয়ে যাচ্ছে।

দিঘিটির অবস্থান জলপাইগুড়ি পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলার মানেকা ঈশোরের বাড়ির কাছাকাছি। তিনি বলেন, “মৎস্য দফতর থেকে একসময় এসে দিঘিটি দেখে যায়। আমরা চাই পুরসভার পক্ষ থেকে এলাকায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে দিঘিটির দায়িত্ব দেওয়া হোক। পুকুরটিতে তারা মাছ চাষ করতে পারবে। পুকুরটিও পরিস্কার থাকবে।”

Advertisement

পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে আদরপাড়ার দুলাল দিঘি। মতান্তরে দুলালি দিঘি। দুই একর জায়গা নিয়ে দিঘিটির অবস্থান। জল কচুরিপানায় ভরা। চারপাশে জঙ্গল। চারপাশের বাড়ির দুষিত জল পুকুরটিতে এসে পড়ছে। ২০০৬ সালে একবার দিঘিটি সংস্কার করা হয়েছিল। তারপর থেকে আর কিছু হয়নি। এই দিঘিটিকে নিয়ে একটি প্রচলিত গল্প আছে। গল্পটি শুনিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায়। তিনি বলেন, “গল্পটা হল করলা তিস্তার কন্যা। করলার সঙ্গে গদাধরের(দুলালদিঘির কাছের ছোট নদী) ভালবাসা ছিল। করলা গদাধরের সঙ্গে এই দিঘির পাশে বসে গল্প করতো। আমরা একবার দিঘিটি সংস্কার করিয়েছিলাম। তারপর আর কিছু হয়নি।” এলাকার যুবক বুবাই ঘোষ, কার্তিক রায় বলেন,“পুকুরটিকে ব্যবহারযোগ্য করে দেওয়া হোক। আমাদের আবেদন নিয়মিত পুকুরটি পরিস্কার করা হোক।”

১৪ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কংগ্রেসপাড়ায় একসময় একটি ডোবা ছিল। ১৯৮১ সালে পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে ডোবাটি সংস্কার করে অনেকটা খুঁড়ে দেওয়া হয়। ডোবাটি একটা পুকুরের মত হয়। ২০০৪ সালে এসজেডিএর পক্ষ থেকে পুকুরটিকে পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে মনোরম করে তোলা হয়। এখন রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে পুকুরটির বেহাল দশা। বাঁধানো পার, স্নানের ঘাট সবই ঠিক আছে। এলাকার বাসিন্দার জানিয়েছেন যে জল দূষিত হয়ে গেছে। ধর্মীয় কারনে অনেকে পুকুরটি ব্যবহার করে থাকেন। মাটির মূর্তি, পুজোর ফুল, বেলপাতা এই পুকুরটিতে ফেলেন। কিছু লোক এখানে মাছ ধরেন। মাছের খাবারের সাথে ইউরিয়া জলে ফেলেন। এখন জলের রং পাল্টে গেছে। এলাকার বাসিন্দা বাবু বসাক, দেবাশিস রায় বলেন, “রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই এই পুকুরটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই পুরসভার পক্ষ থেকে যারা পুকুরটিকে দূষিত করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। পুকুরটিরও রক্ষনাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক।”

এক সময় জলপাইগুড়ির রাজাদের গোমস্তা ছিলেন দিনু গোমস্তা। তার নামেই গোমস্তাপাড়া নাম হয়েছে। তিনি এই এলাকায় একটি মসজিদ স্থাপন করেন। সেই মসজিদটিই এখন ৪ নম্বর ঘুমটির মসজিদ নামে পরিচিত। এখানে হাত, মুখ ধোয়ার জন্য তিনি একটি পুকুর স্থাপন করেন। মসজিদ সংলগ্ন পুকুরটি এখনও আছে। এই পুকুরটিরও খারাপ অবস্থা। জলে নোংরা ফেলার ফলে জলের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।

২০ নম্বর ওয়ার্ডের বামনপাড়া প্রাথমিক স্কুল সংলগ্ন ১০ বিঘা জায়গা নিয়ে বিলটি কেউ একজন কিনে নিয়ে ভরাট করছেন। একসময় এই বিলটিতে পরিযায়ী পাখিরা আসতো। এলাকার সমস্ত জল বিলটিতে পড়তো। এখন বিলটিতে মাটি ফেলার ফলে জল কমে গেছে। এখন একটু বৃস্টি হলে জল বার হতে না পেরে এলাকায় জমে যাচ্ছে। বিল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আশিস সুত্রধর, গোবিন্দ সুত্রধর বলেন, “বিলটি ভরাট করার ফলে এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আমরা সমস্যার সন্মুখীন।”

১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেহেরুন্নিসা স্কুল সংলগ্ন পুকুরটির খুবই খারাপ অবস্থা। পানা এবং জঙ্গলে পরিপূর্ন। বাঁধানো ঘাটটি ভেঙে গেছে। চারপাশের উঁচু মাটির বাঁধ অবলুপ্ত। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কান্তেশ্বর দিঘির অর্ধেকটা জল অর্ধেকটা পুকুর। পুকুরের মধ্যে কিছুটা অংশ বুজিয়ে একটা মন্দির তৈরি করা হয়েছে। এদকসময় জলপাইগুড়ি স্টেশন তৈরির সময় মাটির প্রয়োজনে পাশে একটি পুকুর তৈরি করা হয়। সেই পুকুরটিরও বেহাল দশা। পান্ডাপাড়া কালিবাড়ির কাছের কাঁচা পুকুরটি এদবং ডাঙাপাড়ার বাঁধানো পুকুরটি এলাকার বাসিন্দারা ঠিকঠাক রেখেছেন। বাকি সব পুকুরগুলির অবস্থা খারাপ। ইতিহাসবিদ আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, “এক সময় রাজারা পুকুরগুলি তৈরি করেছিলেন। এখন রাজারা নেই। পুরসভা পুকুরগুলিকে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির হাতে তুলে দিলে পুকুরগুলিতে মাছ চাষ হতে পারে।” জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু বলেন, “আমরা কয়েকটি দিঘিকে রক্ষনবেক্ষনের ব্যবস্থা করছি। এলাকায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে কেউ যদি কোন পুকুরে মাছ চাষ করতে চান আমরা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবো।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন