প্রবল গরমে বেলা বাড়তেই ঘরবন্দি বাসিন্দারা। বালুরঘাটের ব্যস্ততম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শনিবার দুপুরে যেন বন্্ধের চেহারা। ছবি: অমিত মোহান্ত।
পাহাড়ে সারাদিনই বইছে শীতল বাতাস। পাহাড়ের পাদদেশের শিলিগুড়িতে অবশ্য তেতে উঠেছে বাতাস। তবে তা এখনও বাসিন্দাদের কাছে সহনীয়। কিন্তু, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহের এমন গরম বাতাস বইতে শুরু করেছে যে তা প্রায় সহ্যের বাইরে।
গরম লু বইছে বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকায়। রাস্তাঘাট সুনসান। দোকান-বাজারেও লোকসমাগম তুলনায় কম। বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ ছুটি। যেখানে পরীক্ষার জন্য স্কুল খোলা সেখানে কাহিল অবস্থা পড়ুয়া-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। অফিস-কাছারিতেও সকলে হাঁসফাস করছেন। তবে সমতলে আলিপুরদুয়ার জেলার তাপমাত্রা ছিল অনেক আরামদায়ক। জেলার নানা এলাকায় শুক্রবার রাতে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। কালচিনি ব্লকের আটিয়াবাড়ি চা বাগানের ম্যানেজার নিত্যানন্দ মাহাতো বলেন, ‘‘বেশি বৃষ্টি বা বেশি গরম দুটোই চা গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক। বেশী বৃষ্টি হলে দিনের বেলায় শ্রমিকদের কাজের অসুবিধের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় জল জমে সমস্যা সৃষ্টি হয়। বেশি গরম পড়লে চা গাছের কচি পাতা বের হয় না। পাতা শুকিয়ে যায়।’’
গরম থেকে বাঁচতে। শিলিগুড়ির পথে শনিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
শনিবার বালুরঘাটে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায়। মালদহেও একই তাপমাত্রা ছিল। বালুরঘাট শহরের মনিমেলা এলাকার একটি বেসরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল দুপুরে চলায় কচিকাঁচারা গরমে কষ্ট পাচ্ছে বলে অভিভাবকদের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ওই স্কুলের প্রধান আচার্য উত্তম সরকার বলেন, ‘‘পরীক্ষা চলছে বলে স্কুল চালু রয়েছে। আগামী ৩ জুন থেকে গরমের ছুটি দেওয়া হবে।’’ প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে মাটির নীচে জলস্তর নেমে যাওয়ায় জেলার তপন, বংশীহারি ও হরিরামপুর ব্লকের বেশ কিছু এলাকায় নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে। পানীয় জলের সঙ্কট তৈরি হয়েছে।’’
মালদহের চাঁচল মহকুমা জুড়েই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সকাল থেকেই তাপমাত্রার পারদ চড়তে থাকে। ফলে গরমের আঁচ বুঝতে পেরে এ দিন সাতসকালেই জামাইষষ্ঠির কেনাকাটার জন্য বাজারে কার্যত হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন ক্রেতারা। বেলা বাড়তেই পথঘাট সুনসান হয়ে যায়। দুপুর থেকে বিকেল পর্য়ন্ত রাস্তাঘাটে ছিল অঘোষিত বন্ধের চেহারা। তবে বাড়িতেও স্বস্তি ছিল না। জাতীয় সড়ক চওড়া করার জন্য বিদ্যুতের খুঁটি সরানো হচ্ছে। তাই পূর্ব নির্ধারিত সূচি মেনে এ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটে পর্য়ন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল শহরে। দীর্ঘ সময় গরমে নাজেহাল হন বাসিন্দারা। বাতাসে আদ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় গরমে বেশি অস্বস্তি হচ্ছে বলে চিকিত্সকেরা জানিয়েছেন। এই অবস্থায় ভাজা ও মশলা জাতীয় খাবার না খাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। চাঁচলের প্রাক্তন এসিএমওএইচ চিকিৎসক স্বপন বিশ্বাস জানান, তরমুজ, ডাব, তালের শাঁস-সহ জলীয় খাবার খেলে অস্বস্তি কিছুটা হলেও কমবে। জরুরি কাজ ছাড়া রোদে না বের হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
জলপাইগুড়িতে বিকোচ্ছে হাতপাখা।
রায়গঞ্জে এ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে আদ্রতার পরিমাণ ছিল ৫০ শতাংশ। রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় জানান, গরমে গত এক সপ্তাহ ধরে ডায়েরিয়া ও পেটের রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ১১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। জেলা উপ কৃষি অধিকর্তা শাশ্বতকমল রায় জানান, বর্তমানে জমিতে ভুট্টা ও ধান কাটার কাজ চলছে। এ রকম আবহওয়া থাকলে গরমে সেই কাজ ব্যাহত হবে। তাছাড়া এক সপ্তাহের মধ্যে তাপমাত্রা না কমলে বা বৃষ্টি না হলে শাকসব্জি ও পাটচাষে ক্ষতি হতে পারে। প্রচণ্ড রোদের কারণে বেলা ১১টা থেকে রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ, ইটাহার, করণদিঘি, ইসলামপুর, চোপড়া গোয়ালপোখর-১ ও ২ ব্লকের বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটে লোকজনের সংখ্যা অন্য দিনের থেকে কম চোখে পড়ে।
গরমের জেরে প্রভাব পড়ছে পর্যটনেও। লাটাগুড়ি রিসর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশেনর সম্পাদক দিব্যেন্দু দেবের কথায়, ‘‘ডুয়ার্সে ভালই গরম রয়েছে। তাই ৪০ শতাংশের বেশি পর্যটক এই মুহূর্তে লাটাগুড়ি গরুমারাতে নেই। তবে গরম যতই বাড়ছে ততই পাহাড়ি পর্যটন কেন্দ্রের প্রতি টান বাড়ছে পর্যটকদের। লাভা , লোলেগাঁও , ঝান্ডি, ঝালং সবেতেই কার্যত পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে।’’ কলকাতার বাসিন্দা অরুনাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ই যেমন মালবাজার হয়ে লাভার পথে ঘুরতে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘গরমে অতিষ্ঠ হয়েই বেড়িয়ে পড়েছি। ডুয়ার্সে কলকাতার থেকে গরম অনেক কম হলেও পাহাড়ের ঠান্ডা আবহাওয়াতেই আরামে কটা দিন কাটাতে চাইছি।’’
কোচবিহারে ছিল চড়া রোদ। বেলা যত বেড়েছে তত বেড়েছে তাপমাত্রার পারদ। বিকেলের দিকে অবশ্য খানিকটা মৃদু হাওয়া ছিল। সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি মৌসম সেবা কেন্দ্রের নোডাল অফিসার শুভেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় গরমে অস্বস্তির ভাব বেশি হচ্ছে। তবে রবিবার কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।”
শনিবার দুপুরে জলপাইগুড়ি শহরে রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। পথচারিরা তো বটেই, রিকশা চালকেরাও গাছের ছায়া খুঁজে শরীর এলিয়ে দেন। রাস্তার ধারে ডাব বিক্রেতাদের আশপাশে ভিড় উপচে পড়েছে। রাত পোহালেই জামাইষষ্ঠী। তাই ঘামে ভিজে শহরের দিনবাজার, স্টেশন বাজারে শ্বশুর, শাশুড়িরা ভিড় করেছেন পছন্দের মাছের খোঁজে। করলা সেতু জুড়ে এ দিন ছিল ফল, দূর্বা, হাতপাখার বাজার। শুক্রবারের মতো কড়া রোড না থাকায় এ দিন তবু সামান্য হলেও স্বস্তি ছিল। শনিবার তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে।