এ কি হচ্ছে সরে যান না আরে আরে

সে দিন ৯ নভেম্বর, কাজ থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে সময়ে অসময়ে যেমন হয়। রাতে খবর দেখা হয়নি। ফোন খুলে ফেসবুক দেখারও সময় হয়নি। মাস মাইনে সম্বল ব্যক্তিকে রাতে ওই দুঃসাহসিক সংবাদটি কেউ যেচে পড়ে দেওয়ারও নেই।

Advertisement

সেবন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ০২:০৮
Share:

সে দিন ৯ নভেম্বর, কাজ থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে সময়ে অসময়ে যেমন হয়। রাতে খবর দেখা হয়নি। ফোন খুলে ফেসবুক দেখারও সময় হয়নি। মাস মাইনে সম্বল ব্যক্তিকে রাতে ওই দুঃসাহসিক সংবাদটি কেউ যেচে পড়ে দেওয়ারও নেই। ফলে পরদিন ভোরে পরম চা আর খবরের কাগজের প্রথম পাতা—দু’টোই ছ্যাঁক করে এসে গায়ে লাগল।

Advertisement

১০ নভেম্বর সকাল সাতটা। কিন্তু সামলাবো কোনটা? হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার এদিক-ওদিকে দুনিয়ার ওপার এপার। ‘সাদা’ হয়ে যাওয়ার রসিকতাময় সমাপতন খুঁজব, না ঝপ করে পার্স হাতড়াতে বসব? পার্সে পাওয়া গেল দু’টি হাজার টাকার নোট। এ দিক-ও দিক হাতড়ে খুচরো আরও হাজার খানেক। ব্যস, এ বার কাজে বেরিয়ে পড়া।

বিকেল চারটেতে বাড়ি ফিরে খাওয়া মাথায়। পাশের বেসরকারি ব্যাঙ্কে দৌড়। নেট অন করে দেখে যাচ্ছি সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য গুজবের ঢেউয়ে দেশ ভাসছে। দু-হাজার না চার। চেকে দশ না কুড়ি? দিনে দশ হলে সপ্তাহে কেন কুড়ি? মুদির দোকান, রাস্তার টাটকা সব্জি বাজার ছেড়ে তা হলে সবাই শপিংমলে বাসি সব্জি ইত্যাদি ইত্যাদির মধ্যে দেখছি কেউ কেউ সমর্থন করছেন, কেউ কেউ গাল পাড়ছেন।

Advertisement

ব্যাঙ্ক কর্মীদের দেখে মনে হচ্ছিল সেনাবাহিনীর বিকল্প হতে পারে এঁরা। লাইন ঠেলে পরিচয় পত্র, তার প্রতিলিপি, টোকেন, ফর্ম ফিল ইন, ক্যাশ কাউন্টার সেরে একশো টাকার দু’হাজার টাকা নিয়ে বাইরে এলাম। অনেক দিন পর বাঘা যতীন পার্কে কাটানো শৈশব মনে পড়ছিল। মোড়ের মাথা থেকে কুড়ি টাকা দিয়ে গরম বাদাম ভাজা আর ঝাল নুন নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ঠিক যে ভাবে তিরিশ বছর আগে বাবা আনতেন।

১১ নভেম্বর, গতকাল ছেলের স্কুল বাস ফি’র জন্য নির্দিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে লাইন ছিল এককালের ব্রিগেড মিছিলের মতো। তবে শান্ত। জনগণ এমন ধৈর্য দেখাচ্ছেন, যা এক কথায় অভাবনীয়। কাজের যা ধরণ, ওই লাইনে দাঁড়াবার সময়, সুযোগ কোনওটাই নেই আমার। ফলে আজও ফি দেওয়া হল না। কর্মস্থল দাগাপুর থেকে ফেরার সময় মহানন্দা ব্রিজে বাস দাঁড়িয়ে গেল তো গেলই। কিন্তু কিছু ক্যাশ তো দরকার। ঘরে আমার পঁচাত্তর বছরের মা, ছেলে ছোট। চাকরির ধরন সকাল আটটা থেকে সাড়ে তিনটে। বিকেলে লাইনে দাঁড়াতে গেলে গার্ড জানিয়ে দিলেন টাকা নেই। বাড়িতে ডিম চলছে কারণ সেটি পাশের মুদিখানা থেকে ধারে আসতে পারে।

১২ নভেম্বর, ফ্যাতাড়ুর শহর হয়ে উঠেছে। কাজের মাসি, পরিচারিকা ড্রাইভার, যাদের অ্যাকাউন্ট আর প্যান আছে, তাদের এ-ক’দিনে গুরুত্ব বেড়েছে। আবার বাড়ির সামনে ব্যাঙ্কে ধর্না দিলাম।

১৩ নভেম্বর, সকাল ন’টায় বাড়ির পাশে সেই লাইনেই আছি। সঙ্গে জল, শুকনো ফল। ফাইলে অস্তিস্ব রক্ষার যাবতীয় পরিচয় পত্র। আজ, এস্পার না ওস্পার। নিরাপত্তারক্ষী দুটি লাইন করানোর চেষ্টা করছেন। এক কর্মী একটু উঁচু গলায় কথা বলতে যেতেই জনতা আজ আরও উঁচুতে। মানে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে।

অবশেষে টাকা তুলতে পেরেছি। কিন্তু দেখছি, যৌনকর্মীর ব্যবসা বন্ধ। ঠিকাদার, ঠেলাওয়ালা, অধ্যাপক, উকিল, ছাত্র, ডাক্তার, জ্যোতিষি সব একাকার। টাকার গল্প ছাড়া গল্প নেই। এমন বিষম সাম্য আমরা কে কবে দেখেছি?

লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বারবার ঠেলা খাচ্ছিলাম। নানা রকম লোক ছিলেন। বারবার মনে পড়ছিল শঙ্খ ঘোষের ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ কবিতার লাইনটা—‘এ কি হচ্ছে? সরে যান-না! আরে আরে—আমরা কি আলাদা? দেখছেন তো সবকটা এই এক সঙ্গে জাপ্‌টানো দড়ি বাঁধা।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement