পৌষের হাওয়ায় উত্তর জুড়ে পিঠে পরব

কথিত রয়েছে, আতপ চালের গুঁড়োর সঙ্গে কতটা গুড় মেশানো হবে, তার ওপরেই নির্ভর করে ভাপা পিঠের স্বাদ। জাল দেওয়ার সময়ে ওঠা গুড়ের সুবাসেই নাকি পায়েসের স্বাদ মালুম হয়ে যায়। জলপাইগুড়ি থেকে বালুরঘাট তাই পিঠে-পুলি তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:০৩
Share:

কোচবিহারের নাককাটিগছে পিঠে তৈরির জন্য চাল কুটছেন মহিলারা। — নিজস্ব চিত্র

কথিত রয়েছে, আতপ চালের গুঁড়োর সঙ্গে কতটা গুড় মেশানো হবে, তার ওপরেই নির্ভর করে ভাপা পিঠের স্বাদ। জাল দেওয়ার সময়ে ওঠা গুড়ের সুবাসেই নাকি পায়েসের স্বাদ মালুম হয়ে যায়। জলপাইগুড়ি থেকে বালুরঘাট তাই পিঠে-পুলি তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। রানিনগর স্টেশনে ট্রেনের হুইশল বাজলেই ভাপা পিঠের সরঞ্জাম নিয়ে চলে আসেন গ্রামের মহিলারা। ময়নাগুড়ির উল্লাডাবড়িতে বাংলাদেশ থেকে আসা এক দম্পতি পিঠে বানাচ্ছেন কি না, তার খোঁজ নিতে বহু দূর থেকেও খোঁজ নিতে আসেন রসিকেরা। সংক্রান্তির আগে অন্য কাজ থেকে ‘ছুটি’ নিয়ে পিঠে তৈরিতে ব্যস্ত উত্তর দিনাজপুরের মহিলারা। এমনই নানা পিঠে-কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে তিস্তা-মহানন্দা-আত্রেয়ীর পাড়ে।

Advertisement

বাঁশি শুনেই ছুট

ট্রেনের হুইশল কখন শোনা যাবে, সেই অপেক্ষাতেই যেন সকাল থেকে বসে থাকেন ওঁরা৷ বাঁশি শুনলেই গামলা নিয়ে স্টেশনে দৌড়। ট্রেন দাঁড়ায় সামান্য সময়ে। তাতেই চুটিয়ে ব্যবসা। বছরের পর বছর এ ভাবেই ভাপা পিঠে বেচছেন জলপাইগুড়ির রানিনগর স্টেশন সংলগ্ন এলাকার মানুষ৷ পৌষ পার্বণ বলে আলাদা কিছু নেই। বছরের যে কোনও সময়েই স্টেশনে যান, মিলবে ভাপা পিঠে। মোটে পাঁচটা ট্রেন দাঁড়ায় এখানে। তাতেও কিন্তু গামলা শূন্য হয়ে যায় তাঁদের। প্রথমে শুধু মহিলারাই আনতেন পিঠে বানিয়ে। ব্যবসা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে বিক্রেতার সংখ্যাও। এখন পুরুষেরাও তাতে সামিল। স্থানীয় পিঠে বিক্রেতা সঞ্জয় বর্মন বলেন, ‘‘আমি বেচি ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে মহিলারা মিলেই পিঠে বানান৷’’ দুর্ঘটনায় পায়ে চোট পান নিতাই রায়। তার পর থেকে ভারী কাজ বন্ধ। তাই পিঠে বিক্রি শুরু করেন। কারা বেশি কেনে? মীনা রায় জানালেন, এই ব্যাপারে এগিয়ে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসের যাত্রীরাই। রানিনগর স্টেশনে ভাপা পিঠে কিনতে কিনতে বেহালার বাসিন্দা তাপস সরকার বলছিলেন, ‘‘আগে একবার উত্তরবঙ্গে এসেছিলাম৷ তখন এখানে ভাপা পিঠে খেয়ে বাড়িতে গল্প করেছি৷ এ বার তাই বাড়ির জন্যও পিঠে নিয়ে যাচ্ছি৷’’

Advertisement

মায়ের শিক্ষা

বাংলাদেশে থাকার সময়ে মায়ের কাছ থেকে হরেক রকম পিঠে তৈরি শিখেছিলেন আদুরি। সেই স্বাদই এখন এখন উল্লাডাবরির বাসিন্দা তিনি ও তাঁর স্বামী নকুল পালের পিঠে-ব্যবসার মূলধন। জাতীয় সড়কের ধারে হোটেল খুলেছেন দম্পতি। দুই ছেলে, দুই মেয়েকে নিয়ে ভরপুর সংসার। দিব্যি চলে যায় হোটেল আর পিঠে বিক্রির পয়সায়। বাড়িও বানিয়েছেন এই ব্যবসা করে। সংক্রান্তির আগে ব্যস্ততা বেড়ে যায় গোটা পরিবারের। মুগ পুলি, মিষ্টি আলুর পুলি, পাটিসাপ্টা, মালপোয়া, চিতোই পিঠে, ভাপা পিঠে, রসপুলি, সাদা পিঠে— কত রকম পিঠে বানান তাঁরা বলে শেষ করা যাবে না। এই পিঠে পরিবারের সুবাস ময়নাগুড়ি ছাড়িয়ে জলপাইগুড়ি, ধূপগুড়ি, চ্যাংরাবান্ধাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। আদুরি দেবী বলেন, ‘‘এখন তো রাত জেগে পিঠে বানাতে হচ্ছে। দিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছি না!’’

পিঠেপুলির কথা অনেক সময় এসেছে অনেক ছবিতেও। সাড়ে চুয়াত্তরে ভানুর সেই মালপোয়া খাওয়ার আব্দার অবিস্মরণীয়। ঋত্বিকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ পিঠে তৈরির এই দৃশ্য ভোলার নয়।

হরেক পুলির স্তূপ

ছোটবেলা মা-ঠাকুমার হাতে তৈরি পিঠের স্বাদ ভোলা কী সহজ কথা! সেই স্বাদের খোঁজে এখনও সবলা মেলায় পিঠের স্টলে ঘুরে বেড়ান অনেকে। কবি, নাট্যকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ। পুরনো স্বাদ যে সব সময়ে মেলে, তা নয়। তবে তেল পিঠে, ক্ষীর-নারকেলের পুর দেওয়া পাটিজোড়া, মুগের পুলি, মিষ্টি আলুর পান্তুয়া, দুধ পুলির গন্ধ ম ম হয়ে রয়েছে সবলা মেলার সর্বত্র। আর এত মিঠে খেতে খেতে যদি স্বাদবদলের ইচ্ছে হয়, তা হলে রয়েছে কালো জিরে ব্যাসনে ডুবিয়ে ছাঁকা সর্ষে তেলে ভাজা বেগুনি। পিঠে চাখতে চাখতে শিক্ষক সুভাষ সাহা বলছিলেন, ‘‘বাড়ি বাড়ি ঘুরে পিঠে খাওয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে পকেটে চালান হয়ে যেত তেল পিঠে থেকে পাটি জোড়া।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মা-ঠাকুমারা নেই। তবে শহরের মোড়ে মোড়ে এখন দোকান করেছেন কয়েক জন প্রৌঢ়া। তাঁদের হাতে তৈরি ভাপা পিঠের স্বাদেই এখন মশগুল এলাকা।’’ খেজুর গুড়ের পুর দেওয়া চালের গুঁড়োর গরম ভাপা পিঠের গন্ধে শীতের সন্ধ্যায় ইদানীং জমে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণও। সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন নাট্যকর্মী কমল দাস, কবি মৃণাল চক্রবর্তী বা রাহুল বাগচী এবং সমাজসেবী পীযুষ দেবরা। মেলায় পিঠে নিয়ে হাজির হতে তাই মাহিনগর এলাকার গোষ্ঠীর মহিলাদের ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে।

ফাস্ট ফুড, না পিঠে

সারা বছর কেউ স্বামীর সঙ্গে চাষাবাস করেন, কেউ আবার পরিচারিকা। শীতের মরশুমে ওঁরাই লেগে যান ভাপা পিঠে তৈরি করতে। উত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকার এমনই জনা পঞ্চাশেক মহিলা এই সময়ে দখল করে নেন রায়গঞ্জের বিভিন্ন বাজার। ভাপা পিঠের টানে তাঁদের দোকানে হাজির প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে পুরকর্মী, সাধারণ মানুষও। মোহনবাটি বাজারে দাঁড়িয়ে এমনই ভাপা পিঠে খেতে খেতে সুজন দত্ত বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলায় মা, দিদা ও ঠাকুমার হাতে তৈরি কত ধরনের পিঠে খেয়েছি। এখন তো আর বাড়িতে সে ভাবে পিঠে তৈরি হয় না। এখনকার ছেলেমেয়েরা তাই বাজারের পিঠে খেয়েই সন্তুষ্ট থাকে।’’ এফসিআই মোড় বাজারে গত তিন বছর ধরে ভাপা পিঠে তৈরি করে বেচছেন বরুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা নির্মলা সিংহ। পেশায় পরিচারিকা নির্মলা এই সময়ে পিঠে তৈরি করে বেচতে আসেন বাজারে। বলছিলেন, ‘‘ফাস্ট ফুডের যুগে বেশির ভাগ বাঙালির ঘরে পিঠে তৈরির রেওয়াজ নেই। এই প্রজন্মের বেশির ভাগ মহিলা তাই পিঠে তৈরি করতে পারেন না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন