ডাকাতের ‘মা’ প্রীতিতেও বাঁধেন

কালীতলার বুড়াকালীর আশীর্বাদ না নিয়ে ডাকাতিতে বেরতো না জলদস্যুরা। আরাধ্যাকে তুষ্ট করতে চলত নরবলিও। কালী কানে শোনেন না, কিন্তু ভক্তের মনস্কামনা পূরণ করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আবার হিন্দু-মুসলমান একত্রিত হয়ে অনায়াসে বছরের পর বছর পুজোয় ধরে রাখেন সম্প্রীতির সুর। হারিয়ে যাওয়া সে সব গল্প ফিরে দেখলেন অনিতা দত্ত। মহানন্দা ধরে কোন পথে আসছে বণিকরা! ভরা ঝোপজঙ্গলের আড়ালে তক্কে তক্কে থাকত দস্যুদল। বজরা কাছে ভিড়লেই আক্রমণ। বণিকদের পণ্যে হানা দিয়ে লুঠ হয়ে যেত সমস্ত সামগ্রী। কিন্তু ‘মায়ের’ আশীর্বাদ না থাকলে ডাকাতি ব্যর্থ হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৬ ০২:০৫
Share:

এখন স্থায়ী মন্দির। প্রায় চারশো বছর আগে দস্যুরা এই কালীতলাতেই পুজো দিত। (ডান দিকে) বয়রা কালী প্রতিমা। — নিজস্ব চিত্র

মহানন্দা ধরে কোন পথে আসছে বণিকরা! ভরা ঝোপজঙ্গলের আড়ালে তক্কে তক্কে থাকত দস্যুদল। বজরা কাছে ভিড়লেই আক্রমণ। বণিকদের পণ্যে হানা দিয়ে লুঠ হয়ে যেত সমস্ত সামগ্রী। কিন্তু ‘মায়ের’ আশীর্বাদ না থাকলে ডাকাতি ব্যর্থ হবে। নদীর পাশের কালীতলায় বুড়াকালীর পুজো দিয়ে বেরনো তাই রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়। সঙ্গে নিয়মিত চলত নরবলিও।

Advertisement

মালদহের ইংরেজবাজারে জলদস্যুদের এই জনশ্রুতি প্রায় চারশো বছর পুরনো। নরবলি বন্ধ হওয়ার পিছনের কাহিনিটিও চমকপ্রদ। ডাকাত দল একবার এক বণিককে মায়ের কাছে বলি দিতে উদ্যোগী হলে দেবীর কৃপায় তিনি রক্ষা পান। ডাকাত দলের সর্দার মারা যায়। সেই থেকে বন্ধ হয়ে যায় নরবলি। মন্দিরের পুরোহিত প্রসূন ভট্টাচার্য জানান, তাঁরা সাত পুরুষ ধরে এই মন্দিরের সেবাইত হিসেবে রয়েছেন। বছর ভর নিত্যপুজোর পাশাপাশি দু’বার বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। তার মধ্যে একটি এই দীপান্বিতার দিন। অন্যটি হয় ভাদ্র মাসের অমাবস্যায় ফলহারিণী কালীপুজো। দীপান্বিতা অমাবস্যায় পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে মাকে নিবেদন করা হয় ছোলার ডালের খিচুরি ভোগ।

ও দিকে কালিয়াগঞ্জের বয়রাকালী মন্দিরে পুজো দিয়েও রাতের অন্ধকারে দস্যুরা ডাকাতি করতে বের হতো। বয়রাকালী নামের পিছনে রয়েছে দু’টি ভিন্ন মত। কারও মতে এই কালীমন্দিরের পাশে এক সময় নাকি একটি বয়রা গাছ ছিল। যার থেকে বয়রাকালী নামের উৎপত্তি। আরেকটি মত বলে এই কালী বধির অর্থাৎ বয়রা।

Advertisement

মন্দির গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে একটি গল্প। মন্দিরের পাশেই ছিল খরস্রোতা শ্রীমতী নদী (যা এখন মজা)। এই নদী পথেই লুঠ করতে বেরনোর আগে ডাকাতরা পুজো দিত এই কালীকে। অনুমান মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৮০ থেকে ১৮৯০-র মধ্যে। ১৯৩০-এ দারোগা মজমুল হক টিনের চালাঘর তৈরি করে দেন। ১৯৬৬ সালে পাকা দালান এবং ২০০৫ সালে বর্তমান মন্দির চেহারা পায়। বর্তমানে পূজিত অষ্টধাতুর মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯৮ সালে।

দীপান্বিতা অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। সে দিন মাকে স্বর্ণালঙ্কারে সাজিয়ে তোলা হয়। পরানো হয় সীতাহার, মণিহার, কোমরবিছা, রতনচূড়, কানপাশা প্রভৃতি। এই পুজোয় পাঁচ রকমের মাছ রান্না করা হয় বলে জানালেন মন্দির কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মুন্না লাহিড়ি। পুজো উপলক্ষে সাত দিন ধরে চলে মেলা। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বিহার থেকেও প্রচুর ভক্ত আসেন।

বুকে মা কালীর ছবি আঁকা ব্যাজ আটকে গলায় শক্তির প্রতীক লাল রুমাল বেঁধে কালীপুজোর রাতে শান্তি শৃঙ্খলার দায়িত্ব সামলাতে দেখা যায় বাবলু আলি বিশাল মিঞা, গোহান মিঞাদের। হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে পুজোর বিভিন্ন দায়িত্ব তুলে নেন নিজেদের কাঁধে। দিন কয়েক আগে মহরমের মিছিলেও সম্প্রীতির এই ধারাটি ধরা পড়েছে।

মালদহ জেলার রতুয়া ২ ব্লকের গোবরজল গ্রামের পরিচিতি চৌধুরী বাড়ির কালীপুজোকে কেন্দ্র করেই। পুজোর দিন দুই আগে থেকেই আশেপাশের সিমলা, বেতাহা, হরিপুর, গোঁসাইপুর, লোকড়া প্রভৃতি গ্রামগুলি থেকে হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান যুবকদের জমায়ত হতে শুরু করেন চৌধুরী বাড়িতে। এদের মধ্য থেকেই প্রায় ১১টি দলে ১২ জন করে ছেলে নিয়ে তৈরি হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। পুজোকে কেন্দ্র করে লক্ষাধিক লোকের সমাগমে ফি বছর যে সুবিশাল মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে তপন মণ্ডল, সুজন মণ্ডল, তারাপদ, অরুণ বরাকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দায়িত্ব সামাল দেন বিশাল মিঞা, সোহান, বাবলুরা।

সেলিম মিঞা জানালেন, ‘‘আমাদের বাবা কাকাদেরও দেখেছি এই পুজোতে যোগ দিতে।’’ চৌধুরী বাড়ির কালীপুজোকে কেন্দ্র করে আশেপাশের সাত আটটি গ্রামের হিন্দু মুসলমান পরিবারগুলির মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা তৈরি হয়। সেলিমের কথায়, ‘‘দিল্লি, দক্ষিণ ভারতে কর্মসূত্রে যে যেখানেই থাকি না কেন, পুজোর ঠিক আগে বাড়ি ফিরে আসি।’’

চৌধুরী বাড়ির কর্তা শান্তি চৌধুরী বলেন, ‘‘এটা বরাবর হয়ে আসছে। মহরম বা ইদের উৎসবে হিন্দুরাও সমান উৎসাহে যোগ দেন। মহরমের মিছিলে এলাকার হিন্দু ছেলেরা পা মেলান। পথে নেমে মিছিলে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সামাল দেন।’’ প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের এই পুজোয় হিন্দুদের পাশাপাশি আশপাশের গ্রামের মুসলমান মহিলারাও পুজো দিতে আসেন। উৎসর্গ করেন পাঁঠা।

এই মন্দিরের পাশে রয়েছে কালিন্দী নদী। জনশ্রুতি, এক সময় এই এলাকায় বাস করতেন রাজপুতরা। তাদের পেশা ছিল দস্যুবৃত্তি। এক বটবৃক্ষের নীচে তাঁরা কালীর আরাধনা করতেন। রাতে কালীপুজো করে নদীপথে ডাকাতি করতে বের হতেন তাঁরা। এক সময় মহামারীর প্রাদুর্ভাবে রাজপুতদের গ্রামটি ধ্বংস হয়ে যায়।

বর্তমানের গোবরজল গ্রামটি গড়ে ওঠে প্রায় একশো বছর আগে। এ সব তথ্য জানা গেল শান্তিবাবুর কাছ থেকে। কথিত রয়েছে ভবানী পাঠক এই কলিন্দী নদীপথে এসে দিন কয়েক এখানেই কাটিয়ে যান। সেই সময় একটি বটগাছের নীচে তিনিই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো দেন। এ পুজোর একটি বৈশিষ্ট্য এখানকার বলি। এক জায়গায় নয়, মন্দির প্রাঙ্গণে একাধিক জায়গায় বলির স্থান নির্দিষ্ট করতে হয়। সেখানেও উভয় সম্প্রদায়ের যুবকেরা সুষ্ঠু ভাবে তা পরিচালনা করে থাকেন।

মহাশক্তির আরাধনাই হোক কিংবা মহরম বা ইদ উৎসব হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এই ছবিটিই উঠে আসে গ্রামবাসীদের সৌজন্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন