মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। —নিজস্ব চিত্র।
প্রশ্ন: কালিয়াগঞ্জের কংগ্রেস নেতারাও দাবি করেছিলেন, তাঁদের একজনও যাবেন না। কিন্তু ভাইস চেয়ারম্যান দলত্যাগ করলেন। আপনাদের এমএলএ মালদহে দল ছেড়ে দিলেন।
উত্তর: কালিয়াগঞ্জে যা হল, তা শিলিগুড়িতে অচল। এখানে তৃণমূলের ১৭ জন কাউন্সিলর। ওঁরা নিজেদের ১৭টি ভোট এক জায়গায় ফেলতে পারবেন? আর সবাইকে মেয়র, ডেপুটি মেয়র পদের লোভ দেখালে হবে! একটা পদে কজনকে বসাবেন? কাউন্সিলররা সবই বোঝেন। সবাই বাজারের পণ্য নন। টাকা দিলেই বিক্রি হয়ে যাবে! কিছু মানুষ অমানুষ হতে পারে, বাকি সবাই মানুষ।
প্রশ্ন: তৃণমূলের কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়? গৌতম দেবের সঙ্গে ইদানীং কথাবার্তা হয় না! শহরের উন্নয়ন নিয়ে সাহায্য চান না!
উত্তর: উনি মন্ত্রী হওয়ার পরে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। উত্তর দেননি। তাই আর যোগাযোগ করিনি। তবে আমি সব মন্ত্রীদের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখ। প্রাপ্য অর্থ আদায়ে বিধায়ক হিসেবে কিছু বাড়তি সুবিধা কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: বোর্ড মিটিঙে কখনও সকলে মিলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভেবেছেন! মুখ্যমন্ত্রী তো শিলিগুড়িতে উত্তরকন্যা করেছেন, সাফারি পার্ক হয়েছে। তা হলে আপনারা সকলে মিলে চাইলে শিলিগুড়ির জন্য মুখ্যমন্ত্রী করবেন না এটা ভাবছেন কেন?
উত্তর: এটা ভাবছি। শীঘ্রই সব দলের কাউন্সিলরদের নিয়ে বৈঠকে বসব। সকলে মিলে শিলিগুড়ির স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দরবারের জন্য উদ্যোগী হব। ওই বৈঠকে কী হয় তা নাগরিকদের জানাব। যদিও আগে উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সহযোগিতা পাইনি।
প্রশ্ন: তৃণমূল রাজ্যে প্রথম বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে আপনি মহকুমা পরিষদ দখল করেছেন। পুরসভার মেয়র হয়েছেন। পরে বিধায়ক হলেন। চার বার মন্ত্রী ছিলেন। তাই উত্তরবঙ্গের বামপন্থীদের অনেকে আশা করেছিলেন, যে হেতু সূযর্কান্ত মিশ্র জেতেননি, তাই আপনি বিধানসভায় দলের নেতৃত্ব দেওয়ার ভার পাবেন। কিন্তু, দেখা গেল পেলেন সুজন চক্রবর্তী। তা নিয়ে উত্তরবঙ্গে অনেকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে। চাপানউতরও রয়েছে। আপনার প্রতিক্রিয়া কি!
উত্তর: আরে না না। এটা একেবারে দলের ব্যাপার। দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমার কোনও আলাদা ব্যাপার। নেই। পরিষদীয় দল নেতা কলকাতা কেন্দ্রীক হলেই ভাল হয়। আমাকে তো রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আমন্ত্রিত হিসেবে নেওয়া হয়েছে। পার্টিতে আমার যতটুকু গুরুত্ব পাওয়ার কথা তা অবশ্যই পাচ্ছি।
প্রশ্ন: তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলায় প্রধান মুখ ছিলেন আপনি। আপনাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলে দলের অনেকে একান্তে রাজ্য নেতাদের একাংশের সমালোচনা করেন বলে শোনা যায়। যেমন কি না একদা আবদুল রেজ্জাক মোল্লার অনুগামীরাও করতেন। আপনি ক্ষুব্ধ সতীর্থদের কী বলে বোঝান? আচ্ছা, রেজ্জাক মোল্লা তো একটা সময় দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। দিনের পর দিন যোগ্য মর্যাদা না পেলে তেমন আপনি ভাবতে পারেন বলে আপনার দলেই আলোচনা শোনা যাচ্ছে।
উত্তর: আর যা হোক রেজ্জাক মোল্লার তুলনা টানবেন না। ওটা বামপন্থীদের পথ নয়। আমাদের দলের চোখে ছোট বড় বলে কিছু নেই। সকলেই প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা পান।
প্রশ্ন: আচ্ছা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ইনিংস। উনি কেমন কাজ করছেন?
উত্তর: এটা সত্যি আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতা সামনে বসে কখনও শুনিনি। বিধানসভায় এবারই প্রথম শুনলাম। কয়েকটি বিষয়ে তিনি উদ্বিগ্ন মনে হল। যেমন রাজ্যের ঋণগ্রস্ততা, এ ছাড়াও কর্মচারি বেতনের বাড়তি দায়, দলের মধ্যে সিন্ডিকেট লবির দাপাদাপি ইত্যাদি। তবে কয়েকটি বিষয়ে এখনও তাঁকে তেমন সিরিয়াস মনে হল না। যেমন শিল্পায়ন, শূন্যপদে নিয়োগ, মূল্যবৃদ্ধি রোধ ইত্যাদি। তাঁর আর একটি বিষয় আমাকে সাহস জুগিয়েছে, তা হল কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হুমকি, রাজ্যগুলির প্রাপ্য বৃদ্ধি করা, পাওনা আদায় ইত্যাদি। এই পথে আমাদেরও যেতে হবে রাজ্যের কাছে পাওনা আদায় করতে। রাজ্যের কাছে আমাদের পাওনা প্রায় ৮০ কোটি টাকা। রাজ্য অর্থ কমিশন, কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন, বিভিন্ন রাজ্য-কেন্দ্রের প্রকল্পগুলির টাকা সব পুরসভা পেলেও আমরা পাচ্ছি না। কেন? এর জবাব চাইতেই মুখ্যমন্ত্রীর পথেই যাব ভাবছি, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
প্রশ্ন: তৃণমূল তো অনেককেই অফার দিয়েছে বলে শুনেছি। আপনার কাছে কখনও তেমন অফার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে এসেছে?
উত্তর: দুঃখিত। এমন যেন কোনও দিন না হয়। কোনও প্রলোভনের কাছে জীবনে মাথা নিচু করিনি। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে আর তা করার প্রশ্নই নেই। এটা সকলেই জানেন, বোঝেন। ওই স্কুলে পড়িনি।
প্রশ্ন: শিলিগুড়ি পুরসভার ভবিষ্যৎ কি! আপনার রাজনৈতিক জীবনের ভবিষ্যৎ কি! রাজ্যের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ করেই ২০২০ সাল অবধি চালাবেন!
উত্তর: শিলিগুড়ির ভবিষ্যৎ অবশ্যই উজ্জ্বল। সারা দেশের মধ্যে শিলিগুড়ির মতো এরকম ভৌগোলিক অবস্থান, এতগুলি দেশের সীমান্তে অবস্থান একটি শহরের, আর কোথাও নেই। আমরা বামপন্থীরাই শিলিগুড়িকে দেশ তথা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার চেষ্টা শুরু করেছিলাম বলে মানুষ আবারও কাজের সুযোগ দিয়েছেন। দুঃখের কথা বর্তমান রাজ্য সরকারের কোনও সুষম বা ভারসাম্যমূলক নগরায়ণ নীতি নেই। তারা বড্ড বেশি প্রসাধনী উন্নয়নে বিশ্বাসী।
প্রশ্ন: অথচ বিরোধীদের অভিযোগ আপনি নাকি ইদানীং কাজের চেয়ে রাজনীতিতেই বেশি আগ্রহী।
উত্তর: কেউ কেউ বলে আমি নাকি উন্নয়নের কাজ থেকে রাজনীতিই বেশি করছি। আমি উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। উন্নয়নেরও রাজনীতি বা অর্থনীতি আছে। আছে একটি নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি। এই অবস্থানে আমি অবিচল। এ সব নিয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে আমি সর্বদাই সচেষ্ট। মনে রাখতে হবে, আমি আর সেই অশোক ভট্টাচার্য নই, যাঁর মাথার উপরে নিজেদের সরকার ছিল। যার শিলিগুড়ির মতো উঠতি মহানগরের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি ছিল। বর্তমান সরকার যেন শিলিগুড়ি বিরোধী। যিনি আগে মেয়র ছিলেন তাঁরও একই অভিজ্ঞতা। উনি ক্ষোভে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি লড়াই করে ২০২০ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যাব। আমাকে টাইট করতে গিয়ে তো শাসক দল শিলিগুড়িকে টাইট করতে চাইলে, সেটা মানা যাবে না। আমি ভাবছি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে সাক্ষাৎ করতে যাব। বিরোধীদেরও থাকতে বলব। শিলিগুড়িকে বঞ্চিত বা বৈষম্য করে তো শুধু সিপিএমের ক্ষতি হবে না, তৃণমূল ওয়ার্ডগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতো নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ করা। তবে বেশিদিন এভাবে আমাদের প্রাপ্য থেকে আটকিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের প্রাপ্য অর্থ বা অধিকার আজ হোক বা কাল পাবই। এই বিশ্বাস আমার আছে।
প্রশ্ন: কর আদায় কি বেড়েছে? তা হলে বহু কর বকেয়া কেন?
উত্তর: আগে বছরে সাড়ে ৪ কোটি টাকা কর আদায় হতো। এখন ৯ কোটি টাকা হয়। তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। চলতি আর্থিক বছরে ১৪ কোটি টাকা কর আদায়ের লক্ষ রয়েছে। শহরের ১৫-২০ হাজার বাড়ি থেকে কর পাওয়া যায় না। সেটা চিহ্নিত করা হচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের কাছে কর বাবদ বকেয়া প্রায় ৭ কোটি টাকা। এটা আদায় করতে হবে। বহু বাড়িতে বহু বাছর ধরে অ্যাসেসমেন্ট বা মিউটেশন হয় না, সেগুলি চিহ্নিত করছি। শিলিগুড়িতে পুরকর ৫০ কোটি টাকা আদায় হতে পারে বলেই মনে করি।
(শেষ)