কখন আসবে টাকা। সেই অপেক্ষাতেই ফালাকাটায় বন্ধ এটিএমের সঙ্গে অপেক্ষা। (ডান দিকে) চাঁচলে টাকা তোলার লাইনে খুদেদের নিয়ে মায়েরা। — রাজকুমার মোদক ও বাপি মজুমদার
ফেরার টাকা নেই
সিকিমের নামচিতে একটি রেস্টুরেন্টে কুকের কাজ করেন জলপাইগুড়ির বাসিন্দা অশোক মাহাতো৷ ব্যাঙ্কে নিজের নামে কোনও অ্যাকাউন্ট নেই৷ দু’মাস পরপর বাড়িতে এসে স্ত্রীর হাতে টাকা দিয়ে যান৷ এ মাসেও ছট পুজোর আগে বাড়ি টাকা দিয়েছেন৷ ঠিক ছিল ছটপুজো পরই সিকিম ফিরবেন৷ কিন্তু নোট সমস্যা অশোক মাহাতোর সব পরিকল্পনাই ভেস্তে দিয়েছে৷ তার কথায়, “বাড়িতে পুরানো পাঁচশো ও হাজারের অনেকগুলি নোট রয়েছে৷ অ্যাকাউন্ট না থাকায় সেগুলি ব্যাঙ্কে জমা করতে পারছি না৷ পরিস্থিতি এমন যে সিকিম ফেরার টাকা এই মুহুর্তে আমার কাছে নেই৷’’ কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
দোকান বন্ধ
আলিপুরদুয়ার জংশনের মাংস বিক্রেতা পিন্টু দাস জানান তাঁর ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট নেই। ছোট পুঁজির ব্যবসা। নোট সমস্যার জেরে ক্রেতারা পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট ধরিয়েছেন। হাতে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা রয়েছে। কী ভাবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছাড়া ওই বাতিল নোটগুলি বদলাবেন তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন। তা ছাড়া ব্যাঙ্ক গুলিতে লম্বা লাইন পড়েছে। তাতে ব্যাঙ্কে গেলে সারাদিন ব্যবসা মার খাবে। দোকান বন্ধ রেখে তাই অ্যাকাউন্ট করতে ছোটাছুটি করছেন।
ধার করে সংসার
রায়গঞ্জের শিল্পীনগর এলাকার বাসিন্দা ষষ্ঠী ঠাকুর পেশায় ক্ষৌরকার। ষষ্ঠীবাবুর শহরের ঘড়িমোড় এলাকায় একটি ছোট সেলুন রয়েছে। কোনওদিন ২০০ আবার কোনওদিন ৫০০ টাকা আয় হয়। দৈনন্দিন সংসারের খরচের পিছনেই টাকা শেষ হয়ে যায়। তা ছাড়া চিকিত্সার জন্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখতে হয়। তাই তাঁর এখনও পর্যন্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করতে পারেননি। দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে সাড়ে ৪ হাজার টাকা জমিয়েছেন। ব্যবসা ফেলে শহরের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরের ভিড়ে লাইন দিয়ে টাকা বদল করার সময় পাচ্ছেন না। দোকানেও ক্রেতাদের দেখা নেই! পাশের একটি পানের দোকানের মালিকের কাছ থেকে শনিবার ১০০০ টাকা ধার নিয়েছেন।
নোট আছে, টাকা নেই
দিনহাটার নাজিরহাট ২ গ্রাম পঞ্চায়েত ( মশালডাঙা) এলাকার বাসিন্দা জাভেদ আলি ক্ষুদ্র কৃষক। সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যায় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করার সুযোগ পাননি। ফলে খরচের পর যা সামান্য টাকা থাকে তা ঘরেই রাখতে হয়। প্রয়োজনে তা দিয়েই সংসার খরচ করি। নোট নিয়ে সমস্যায় ওই সুযোগটাও পাচ্ছেন না। ফলে পাঁচশো টাকার কয়েকটা নোট থাকলেও ভাঙাতে পারছেনি না। ধারদেনা করে চলছে।
সব্জিও নেই ঘরে
ইসলামপুরের লিচু বাগানের বাসিন্দা পেশায় এক নার্সিংহোমের কর্মী জ্যোত্স্না মার্ডি জানান, ইসলামপুরের একটি গ্রামীণ ব্যাঙ্কে এক সময় একটি অ্যাকাউন্ট ছিল তাঁর। কিন্তু টাকা ও সময়ের অভাবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেন। বিছানার তলায় রেখেই বাড়িতেই কয়েক হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেছেন তিনি। এখন কী করে ভাঙাবেন তা নিয়েই বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তাঁর দাবি, সব্জি বাজার করতে যাওয়ারও এখন খুচরো নেই। এ দিন পোস্ট অফিসে এসে সেখানে টাকা বদলের বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন। তিনি বলেন, সামান্য টাকা রয়েছে তা নিয়েও বিপদ। এক বারে বেশি বদলও হবে না। তার উপরে লম্বা লাইন।
দু’টি নোটই বড়
কালকূত বনবস্তির দীনা মিঞ্জ জানান স্বামী দিনমজুরি করেন। আর তিনি জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। বাড়িতে জমানো ২টি পাঁচশো টাকার নোট। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। এখন কী করে সংসার চালাবেন, জানেন না।
ভিড় কমলে অ্যাকাউন্ট
বাবা দিনমজুর। মা অসুস্থ। একমাত্র ভাইও বাবার সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করেন। তবে সেই কাজ প্রতিদিন মেলে না। এই পরিস্থিতিতে সংসারের হাল ধরতে প্রায় এক বছর আগে কাজের খোঁজে মুম্বইতে গিয়ে চাকরি করছেন পাড়ি দিয়েছিলেন রায়গঞ্জের বাহিন গ্রাম পঞ্চায়েতের ঝিটকিয়া এলাকার বাসিন্দা বছর পঁচিশের যুবক ইমরান আলি। তাঁর কাছে নিজের রোজগারের ২০ হাজার টাকা থাকলেও নেই তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। তাঁর দাবি, বাতিল নোট বদল, টাকা জমা ও তোলার ভিড়ের চাপে সব ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন ভিড় না কমা পর্যন্ত নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে না।
দুশ্চিন্তার কালো ছায়া
ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট নেই। এটিএমও কী জিনিস জানেন না। জবকার্ড ভরসা করে ডাকঘরে গিয়ে আতান্তরে পড়লেন দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের চকভৃগু অঞ্চলের বাসিন্দা পরিচারিকা পূর্ণিমা মহন্ত। বাড়িতে অসুস্থ ছেলে। মঙ্গলবার প্রথম চকভুগু সাব পোস্ট অফিসে টাকা দেওয়া শুরু হলো। তাতে পূর্ণিমাদেবীর মতো পেশায় পরিচারিকা ও দিনমজুরের কাজ করা ১০০দিনের জবকার্ডধারী হত দরিদ্রদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু ৫০০টাকার বেশি দেওয়া যাবে না ওই ডাকঘর থেকে সাফ জবাব শুনে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া পূর্ণিমাদেবীদের মুখে