মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়েছিলাম। পেছনেই মধুর চায়ের দোকান। রানিং কাস্টমার ছাড়াও সব সময় পাড়ার কিছু ছেলে বাইরের বেঞ্চে বসে অনন্ত আড্ডা দিতেই থাকে। সে আড্ডার বিষয়বস্তু মঙ্গল গ্রহ কেন লাল থেকে শুরু করে ক্রিকেট বল কেন সাদা হয়ে যাচ্ছে—ইত্যাদি সব কিছুই হতে পারে। অথচ আজ সেই বেঞ্চ খাঁ খাঁ করছে। শুধু আজ নয়, গত ক’দিন ধরেই বিশেষজ্ঞদের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। বুঝতে পারছিলাম, সবাই সব ভুলে ব্যাঙ্ক অথবা এটিএম-এ লাইন দিতে গিয়েছে।
আমি অর্থনীতির কিছুই বুঝি না। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রথম খবরটা জেনে আর সবার মতোই মধ্যবিত্ত মানসিকতায় প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল আমার কাছে এখন কতগুলো সেই বাতিল নোট রয়েছে। তারপরে মনে করতে চেষ্টা করলাম বাজারে চলবে, এমন নোট কত আছে ঘরে। সেই টাকায় কত দিন চালাতে পারব। কবে থেকে ব্যাঙ্ক নতুন টাকা দিতে শুরু করবে। ঘরে যে পুরনো নোট আছে, সে যেন কেঁদে বলছে পুরনো জানিয়া চেয়ো না আমারে। এটাই ছিল আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এটা সহজে লিখছি বটে, আসলে ভেতরে হঠাৎ কেমন যেন একটা কাঁপুনি ধরেছিল। যেন আচমকাই প্রাইমারি স্কুলের রুদ্রস্যার বললেন—তোর নাম আর খাতায় নেই তো। যেন চিরকালের চেনা নদীতে স্নান করতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল পায়ের তলা থেকে বালি সরে যাচ্ছে। চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
টাকাই সব, নাকি টাকা সব নয়—সে কূট তর্ক থাক। টাকার জন্য উদয়াস্ত ঘাম-ঝরানো পরিশ্রম, টাকার জন্য বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, টাকার জন্য ভালোবাসার মৃত্যু, টাকার জন্য বউ-এর গায়ে আগুন, টাকার জন্য জীবন বাজি রেখে মরণগুহায় বাইক চালায় খেলোয়াড়, টাকার জন্য খাদানে চাপা পড়ে মানুষ, বিষাক্ত গ্যাসে মরে যায় হরিজন, বালক। আসলে টাকা মানে তো গরম ভাত। আর ভাত মানে ঝিমিয়ে-পড়া শরীরে একটু উষ্ণতা।
খুব আশ্চর্য হয়েই দেখছি, সাধারণ মানুষ এই নোট বদলের সিদ্ধান্তকে মোটামুটি স্বাগত জানিয়েছে। সবাই বলছে ক’দিন না হয় শাক-ভাত খাব। এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও প্রবল গণবিক্ষোভ দেখেছি। এর পিছনে কী কারণ? সাধারণ মানুষের মনে কী গোপনে কোনও ক্ষোভ ছিল অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে? সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ তো প্রতিপদেই টের পেয়েছে বড় কোনও শক্তির কাছে সে অসহায়। টের পেয়েছে প্রতি পদেই তাকে অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে। চোখের সামনে দেখছে, শুনছে কোথাও কোনও সততার বালাই নেই। এই ক্ষোভটাই হয়তো জমে ছিল।
এখনও এই সিদ্ধান্তের অ্যাসিড-টেস্ট হয়নি। তবে আমরা সবাই যে বড় একটা ঝাঁকুনি খেয়েছি, সেটা অনস্বীকার্য। ঝাঁকুনিটাতে বেশ অনেক কথা বুঝতে পারছি, যা আগে কখনও তেমন করে ভাবিনি।