অতীতে মালদহ ও লাগোয়া উত্তর দিনাজপুরের গোষ্ঠী কোন্দল সামলানোর চেষ্টা করেছেন মুকুল রায়। পরে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও এক-আধবার ভর্ৎসনা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ বার দলনেত্রীর নির্দেশে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ দুই জেলার হাল ফেরাতে আসরে নেমে অভাব-অভিযোগের বহর শুনে চমকে গিয়েছেন তৃণমূলের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী।
রবিবার থেকে মঙ্গলবার টানা তিন দিন দুই জেলায় ঘুরে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক করেছেন। মালদহে বোর্ড গঠনের জটিলতার নিষ্পত্তি করেছেন। রায়গঞ্জে পুরভোটে মুখ থুবড়ে পড়া দলকে ঘুরে দাঁড়াতে একজোট হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু, আড়ালে-আবডালে দুই জেলার যে নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করতে অভ্যস্ত, তাঁদের রাতারাতি ‘মেলানো’ যে সহজ নয় সেটা শুভেন্দুকে জানিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। ফলে, দলের নেতাদের অনেকেরই ধারনা, উত্তরে অভিযানে নেমে গোড়াতেই বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন ‘দক্ষিণ-বিজয়’-এর নায়ক। যদিও শুভেন্দুবাবু বলেছেন, ‘‘আমি তিন দিন ধরে একাধিক বৈঠক করেছি। জেলার নেতাদের সঙ্গে খোলামেলা সব কথাবার্তা হয়েছে। অনেক সমস্যা মিটেছে। দলনেত্রী চান, সকলে দ্বন্দ্ব ভুলে মিলেমিশে কাজ করুক। তা হলে বিধানসভা ভোটে মালদহ, দুই দিনাজপুরে আরও ভাল ফল হবেই।’’
কিন্তু, সাবিত্রী মিত্র-কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী, আবার কৃষ্ণেন্দু-বাবলা সরকারের বিরোধ মেটানো অতই সহজ? অথবা উত্তর দিনাজপুরে তিলক চৌধুরী, অসীম ঘোষ ও অমল আচার্যকে একমত করে কাজ করানোটা কি চাট্টিখানি ব্যাপার? কারণ, দুই জেলার প্রথম সারির নেতাদের অনেক অনুগামীই বৈঠকে একে অন্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে ছাড়েননি। উপরন্তু, দল সূত্রেই জানা গিয়েছে, একান্তে পেয়ে শুভেন্দুকে কয়েকজন জানিয়ে দিয়েছেন, কোথায় কী ভাবে কার মদতে গোলমাল হচ্ছে। আবার কোথায় কে, কী ভাবে স্বজনপোষণের চেষ্টা করছেন। কেউ অভিযোগ করেছেন, মালদহে নানা সময়ে দলের কোন্দলের জেরে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। আবার কোথাও সিভিক পুলিশ নিয়োগ থেকে সরকারি কমিটি গড়ার ক্ষেত্রে যথেচ্ছ স্বজনপোষণ, লেনদেনের অভিযোগও শুনেছেন তৃণমূলের তমলুকের সাংসদ।
শুধু তা-ই নয়, ২০ আসনের পুরাতন মালদহ পুরবোর্ডে ১০ জন কাউন্সিলর নিয়ে বোর্ড গড়ার জন্য সিপিএম ও বিজেপির তিন জন কাউন্সিলরকে ভাঙানোর কাজেও দলের মধ্যে থেকে বাধা উঠেছিল বলে অভিযোগ। দলের কয়েকজন নেতা জানান, ‘শুভেন্দুর হস্তক্ষেপে দল ভাঙানোর কাজ মসৃণ হয়’। সেই সঙ্গে ইংরেজবাজার পুরবোর্ডে ফের কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করার ব্যাপারে প্রবল বাধা দেয় বিরোধী গোষ্ঠী। মন্ত্রী নানা কাজে ব্যস্ত এই যুক্তি দেখিয়ে বাবলাবাবুকে চেয়ারম্যান করার দাবি তোলে। ফলে, ভোটাভুটির সময়ে কৃষ্ণেন্দুবাবু হেরে যেতে পারেন বলে বুঝতে পারেন শুভেন্দু। তিনি সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক করে নিজে বসে থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে দলনেত্রীর পছন্দ হিসেবে কৃষ্ণেন্দুর নাম ঘোষণা করে পরিস্থিতি সামলান।
তার আগে রায়গঞ্জেও বিস্তর ঘাম ঝরেছে তমলুকের সাংসদের। দলের অন্দরের খবর, সেখানে বৈঠকে দলের নেতা-কর্মীদের একে অন্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-অভিযোগের বহর দেখে দৃশ্যত স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি। সেই সময়ে শুভেন্দুবাবু আক্ষেপ করতে দেখা যায়, সে জন্যই উত্তর দিনাজপুরে সভা-সমাবেশে ভিড় হলেও পুরভোটে দল মুখ থুবড়ে পড়ে।
এমনকী, উত্তর দিনাজপুরের জেলা সভাপতি অমলবাবুকে সতর্ক করে দেন শুভেন্দু। তিলকবাবু, অসীমবাবু ও জেলার দলীয় বিধায়কদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিটি পদক্ষেপ না নিলে দলনেত্রী কড়া পদক্ষেপ করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তাতেও অবশ্য দলের যুযুধান নেতাদের অনেকে নিজের জায়গা ছাড়তে রাজি নন বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ফলে, ঘনঘন দুই জেলায় না গেলে যে হাল পুরোপুরি ফেরানো মুশকিল সেটা স্বীকার করেছেন শুভেন্দুবাবুও। তিনি বলেন, ‘‘জুন মাসেই ফের দুই জেলায় গিয়ে থাকব। সব ঠিক থাকলে প্রতি মাসে যাব। জেলায় থেকে যা করার করব।’’