ঠাঁই: হিলির হোমে। নিজস্ব চিত্র
আয়ার ডাকে সাতসকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল ওরা। তারপর একটু ডালিয়া খেয়ে শুরু হয়ে যায় দুই বোনের হুটোপুটি। খেলতে খেলতেই এর-ওর দিকে তাকিয়ে একজন কেঁদে উঠল। তারপর ধরা গলায় বলে উঠল, ‘‘মায়ের কাছে যাব!’’ দেখাদেখি অন্য বোনও একটু ফুঁপিয়ে উঠল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একজন আয়া তাঁদের দু’জনকেই সস্নেহে কোলে তুলে নিলেন। এগিয়ে এলেন আরও একজন আয়া। দু’জনে মিলে দুই যমজ বোনকে একটু আদর করে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কান্না ভুলে বল নিতে আবার মেতে উঠল ওরা।
রাতারাতি খেলাঘর বদলে গিয়েছে বছর আড়াইয়ের শ্রেয়া-শ্রেয়সীর। খেলার ফাঁকে ঘুরতে ফিরতে মায়ের জন্য মাঝেমধ্যেই কেঁদে উঠছে ওরা। তিনদিন আগে মারা গিয়েছে ওদের মা অপর্ণা মজুমদার। তাঁকে পিটিয়ে মারার অভিযোগে বাবা পঙ্কজ মজুমদার, ঠাকুরদা-ঠাকুমা এবং কাকা জেল হেফাজতে। দাদু-দিদার কাছেও তারা আশ্রয় পায়নি। শেষে হিলির এই বেসরকারি হোমই ওদের খেলাঘর, কিছু অপরিচিত মানুষ ও সমবয়সী আরও কয়েকজন শিশু তাদের
খেলার সঙ্গী।
তবে ওদের দাদু হরিশ অধিকারী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘নাতনিদের দায়িত্ব নিলে অভিযুক্তেরা পার পেয়ে যাবে। আবার নতুন করে বিয়ে করবে অভিযুক্ত জামাই। ওরা দুই নাতনির ভবিষ্যতের জন্য উইল করে সম্পত্তি লিখে দিলে ওদের আমরাই বড় করে তুলব। আমি সামান্য দিনমজুর। ওদের মানুষ করব কী করে?’’ তাঁর কথায় সায় দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী শোভাদেবীও। তিনি বলেন, ‘‘বুকে পাথর রেখেই ওদের দায়িত্ব এড়িয়েছি। কিন্তু এছাড়া আমাদের আর কোনও পথ নেই। জামাই তার বাচ্চাদুটোকে ফাঁকি দিক, সেটা চাই না। আমরা দায়িত্ব নিলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে সে।’’ হরিশের অভিযোগ, ‘‘সাধ্যমতো দানযৌতুক দিয়ে কুমারগঞ্জের মোহনার আসবাব ব্যবসায়ী পঙ্কজের সঙ্গে ছোট মেয়ে অপর্ণার বিয়ে দিয়েছিলাম। পণের আরও টাকার দাবিতে পঙ্কজ, তার বাবা-মা সকলেই মেয়ের উপর অত্যাচার চালাত। দিনের পর দিন মেয়েকে না খাইয়ে রাখত। সোমবার রাতে চরম মারধরে দুর্বল মেয়ের শরীর সইতে পারেনি। সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি না করে বাড়িতে ফেলে রেখে ওরা অপর্ণাকে খুন করেছে।’’ যদিও স্ত্রীকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত পঙ্কজ আগেই দাবি করেন, অপর্ণা আত্মঘাতী হয়েছে। ওকে মারধর
করা হয়নি।’’
তবে এসবের কিছুই বোঝে না ওই দুই শিশুকন্যা। একজন আয়া বললেন, ‘‘ওরা খুবই সহজ মনের। খেলার সময় অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে শাসনের ভঙ্গি করছে দেখে আমরা হাসি চেপে রাখতে পারিনি। হয়তো বাড়ি কোনও ঘটনা ওদের মনে পড়া যাচ্ছে। তাই ‘মা যাব’ বলে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠছে, আবার ভুলে গিয়ে খেলায় মেতে উঠছে।’’