সঙ্কটে সিনেমা হল

ভিডিও হল, ডিভিডিতেই তৈরি হয়েছে ধ্বংসের পথ

যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এগিয়ে চলার মত পরিকল্পনার অভাবে ডুয়ার্সের সিনেমা হলগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা তিন-চারটি সিনেমা হল এখন চালু। দর্শকের সংখ্যা তলানিতে ঠেকায় সেগুলিও বন্ধ করার কথা ভাবছেন মালিকেরা।

Advertisement

নিলয় দাস

বানারহাট শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০২:৪৭
Share:

গয়েরকাটায় এখানে ছিল সিনেমা হল। এখন বাড়ি।—নিজস্ব চিত্র।

যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এগিয়ে চলার মত পরিকল্পনার অভাবে ডুয়ার্সের সিনেমা হলগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা তিন-চারটি সিনেমা হল এখন চালু। দর্শকের সংখ্যা তলানিতে ঠেকায় সেগুলিও বন্ধ করার কথা ভাবছেন মালিকেরা। কারণ, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়ছে। সে সময় মান্ধাতা আমলের প্রেক্ষাগৃহে বসে সিনেমা দেখার মত আগ্রহ দেখাচ্ছে না নতুন প্রজন্ম। তার বদলে বাড়িতে বসে ডিভিডি-তে অথবা মোবাইলে ডাউনলোড করে বা ছোট খাটো ভিডিও হলগুলিতে ভিড় জমাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। চা বাগানের দুই যুবকের কথায়, ‘‘ছারপোকার কামড় খেয়ে, গরমের মধ্যে সিনেমা দেখার আগ্রহ আমাদের নেই। সিনেমাহলগুলি ভাল থাকলে অবশ্যই আমরা সেখানে ছবি দেখতে যেতাম।’’

Advertisement

ডুয়ার্সের চা বাগানে শৈশব কেটেছে সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের। এখনও তাঁর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, চা বাগানের কারখানার সামনে ছোট পর্দায় প্রথম দেখা রাজকাপুরের আওয়ারা সিনেমার কথা। তাঁর কথায়, ‘‘কারখানার সামনে শ্রমিকদের জন্য শো দেখানো হত। তবে বাগানের বাবুরা ছুটির দিন লরি ভাড়া করে বানারহাট বা বীরপাড়ায় সিনেমা দেখতে যেতেন। বড়দের সঙ্গে আমিও যেতাম। এখন তো সিনেমা হলগুলি বন্ধ হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো সেখানে বড় আবাস তৈরি হবে।’’

ডুয়ার্সে বেড়ে ওঠা অপর সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার মনে করেন, আসন সংখ্যা কমিয়ে যদি মাল্টিপ্লেক্স এবং রেস্তোরাঁ তৈরি করা হয় তা হলে অবশ্যই সেগুলি চলবে। ডুয়ার্সের বহু মানুষ তো শিলিগুড়ি গিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখছেন। বাড়ির কাছের সিনেমা হলে তারা যেতে চাইছেন না। এই ক্ষেত্রে সিনেমা হল মালিকেরা সরকারের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারেন। সরকারের বিষয়টি দেখা দরকার।’’ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব জানান, রাজ্য সরকার জেলাস্তর থেকে উন্নত মানের প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করছে। তিনি বলেন, ‘‘পরে ব্লক স্তরে কাজ করব। সিনেমাহল মালিকেরা প্রস্তাব দিলে ভাবা হবে।’’

Advertisement

কেন এই দুর্দশা? সিনেমা হল মালিকপক্ষের যুক্তি, নয়ের দশের শুরুতে বাগান লাগোয়া এলাকায় ভিডিও হলগুলি চালু হয়। সেই থেকে বাজার পড়তে শুরু করে। তাতে অনেকটা দর্শকের ঘাটতি দেখা দিলেও সিনেমা হল বন্ধ করার পরিস্থিতি তাতে তৈরি হয়নি। পরবর্তীতে শ্রমিকদের ঘরে ঘরে টেলিভিশন ঢুকে পড়ে। ২০০৫ সাল নাগাদ চিনের থেকে আমদানি হওয়া কম দামি ডিভিডি শ্রমিকদের ঘরে ঢুকতে থাকে। তাতে বড় ধাক্কা খায় সিনেমা হলের ব্যবসা। কয়েক বছর থেকে আবার মোবাইল ফোনে সিনেমা ডাউনলোড শুরু হবার পর সিনেমা হল থেকে বিমুখ হয়ে পড়েন নতুন প্রজন্ম। বছর তিনেক আগে ফিল্মের বদলে অনলাইনে ডিস্ট্রিবিউটররা সিনেমা রিলিজের দিন সে সিনেমা অনলাইনের মাধ্যমে সাপ্তাহিক চুক্তি ভিত্তিতে সিনেমা হল মালিকদের ভাড়া দিচ্ছেন। যে পরিমাণ অর্থ ভাড়া দিতে হচ্ছে সে ক্ষেত্রেও দর্শক না থাকার কারণে লোকসান কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে।

১৯৫১ সালে কালিপদ ঘোষের তৈরি বানারহাটের একমাত্র সিনেমা হলটি বছর চারেক আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার ছেলে শক্তিবাবুর কথায়, ‘‘লোকসানের বোঝা সামলাতে না পেরে হল বন্ধ করতে হয়েছে। সেখানে স্কুল তৈরি করার ভাবনা আছে।’’ তিনি জানান, মাল্টিপ্লেক্স তৈরিতে ৩-৪ কোটি টাকা অর্থের প্রয়োজন।

চা বাগানে ঘেরা নাগরাকাটার গীতা টকিজ বন্ধ হয়েছে ছ মাস আগে। মালিক জ্যোতিষ সাহার কথায়, ‘‘কাঠের সিনেমা হল। ওই সিনেমা হলে দর্শক তেমন হয় না। তাই বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। তবে সরকার এগিয়ে এলে ভেবে দেখা যেতে পারে।’’

গয়েরকাটার মুখোপাধ্যায়দের বাসুদেব সিনেমা হল ২০০৮ সালে বন্ধ হয়েছে। মালবাজার, বীরপাড়া, ফালাকাটা, ধূপগুড়ি আর হ্যামিল্টনগঞ্জের সিনেমা হলগুলিও ধুঁকছে। হ্যামিল্টনগঞ্জের মজুমদার টকিজের মালিক বিজন লাহিড়ির কথায়, ‘‘১০ জন কর্মচারী হল বন্ধ করলে তাঁরা পথে বসবেন। তাদের আবদারে এখনও ক্ষতি স্বীকার করে সিনেমা হল চালাচ্ছি। কারণ, আমার আমার অন্য একটি ব্যবসা রয়েছে। তবে মাল্টিপ্লেক্সের যা টিকিটের হার তাতে চা বাগানে কতটা চলবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন