আলিপুরদুয়ারে জলাশয় বুজিয়ে উঠেছে বসতি, নিকাশি বেহাল

সে ছিল এক অন্য আলিপুরদুয়ার। শহরের নানা এলাকায় ছিল চোখ জুড়ানো জলাশয়। ছোট বড় পুকুর ঘিরে নানা গাছের সমারোহ। এক সময় কোচবিহারের রাজার অধীনে ছিল আলিপুরদুয়ার জনপদ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভুটান দখল নেয় এই জনবসতির। ১৮৬৫ সালে ইংরেজদের সঙ্গে ভুটানের যুদ্ধের পরে সিনচুলা চুক্তি মতে আলিপুরদুয়ার ইংরেজদের দখলে চলে আসে। সেই সময় কালজানি নদীর পাশে ইংরেজরা তাদের সামরিক বাহিনীর একটি ক্যাম্প বসিয়েছিল।

Advertisement

নারায়ণ দে

আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৩০
Share:

নিকাশি নালায় আবর্জনা জমার দৃশ্য চোখে পড়ে সর্বত্রই। নিজস্ব চিত্র।

সে ছিল এক অন্য আলিপুরদুয়ার। শহরের নানা এলাকায় ছিল চোখ জুড়ানো জলাশয়। ছোট বড় পুকুর ঘিরে নানা গাছের সমারোহ।

Advertisement

এক সময় কোচবিহারের রাজার অধীনে ছিল আলিপুরদুয়ার জনপদ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভুটান দখল নেয় এই জনবসতির। ১৮৬৫ সালে ইংরেজদের সঙ্গে ভুটানের যুদ্ধের পরে সিনচুলা চুক্তি মতে আলিপুরদুয়ার ইংরেজদের দখলে চলে আসে। সেই সময় কালজানি নদীর পাশে ইংরেজরা তাদের সামরিক বাহিনীর একটি ক্যাম্প বসিয়েছিল। তার দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল হেদায়েত আলি। তিনিই পরে এই জায়গার ইজারাও পেয়ে যান। ১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি জেলার মহকুমা হয় আলিপুরদুয়ার। সেই সময় অবশ্য মহকুমা সদর ছিল বক্সা পাহাড়ে। পরে ফালাকাটা ও বক্সাদুয়ার ঘুরে মহকুমা সদরের তকমা পায় আলিপুরদুয়ার। তখন থেকেই আলিপুরদুয়ার শহরের অগ্রগতি প্রাণ পায়। আলিপুরদুয়ার কলেজের শিক্ষক শৈলেন দেবনাথ জানান, শহরের গোড়াপত্তনের সময় অধিকাংশ জায়গাই ছিল জলাভূমি। কচুরিপানায় ভর্তি। ছিল বিষধর সাপও। শহর গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জলাশয়ও কমতে থাকে।

তবে তারপরেও গত শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত এই শহরে অনেক জলাশয় ছিল। যা শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা এখনও মনে করতে পারেন। এর পরেই জলা বুজিয়ে বসতি তৈরির শুরু। ধীরে ধীরে জলাভূমি বোজানোর গতি বেড়ে যায়। গত তিন দশকে তো হু হু করে বসতি তৈরি হয়েছে শহরে। বর্ষায় শহরের নানা জায়গার জল গিয়ে যে সব জায়গায় জমা হতো, সেখানে বসতি তৈরি হলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই এখন উপচে পড়ে শহরের নর্দমা। কারণ, সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি আলিপুরদুয়ারে। প্রায় চার দশক ধরে নেতা-মন্ত্রীদের আশ্বাস শুনেছে আলিপুরদুয়ার। তা সত্ত্বেও নিকাশির হাল না ফেরায় ক্ষোভে ফুঁসছে আলিপুরদুয়ার।

Advertisement

পুরসভার ২০টি ওয়ার্ডে গেলে শোনা যাবে একই অভিযোগ। একই ক্ষোভ। ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের অনেকে জানান, ইংরেজ আমলে কিন্তু শহরের নিকাশি যাতে ঠিক থাকে সে জন্য বড় মাপের একাধিক কাঁচা নালা কাটা হয়েছিল। বেশির ভাগই এখন বুজে গিয়েছে। সেই সময়ে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখলে শহরের নিকাশি মুখ থুবড়ে পড়ত না বলে বাসিন্দাদের অনেকেরই মত।

শহরের প্রবীণ শিক্ষকদের কয়েকজন জানান, ২৫-৩০ বছর আগেও শহরের মধ্যে জলাশয়ে প্রচুর মাছ হত। এমনকী, নিকাশি নালায় বর্ষার জলের সঙ্গে ঢুকে পড়ত মাছ। বর্তমানে শহরে ছোট ডোবা প্রায় নেই। নালা এখন আবর্জনায় বন্ধ হয়ে যায় বছরের বেশির ভাগ সময়। বড় নিকাশি নালা দখল করে তার উপরেই গজিয়ে উঠছে দোকান-পাট।

অথচ অতীতের আলিপুরদুয়ার এতটা ঘিঞ্জি ছিল না। শহর গড়ে ওঠার সময়ে বাবুপাড়া, সওদাগরপট্টি, অধুনা বড়বাজার, দেবীনগর এলাকায় জনবসতি ছিল। বাদবাকি অংশে চাষাবাদ হতো। প্রায় সর্বত্রই ছিল কাঠের বাড়ি। অনেকটা উঁচুতে থাকত ঘরদোরের পাটাতন। কারণ, সেই সময় শহরে বক্সার জঙ্গল থেকে বুনো জন্তুরা রাত-বিরেতে ঢুকে পড়ত লোকালয়ে। শহরের অলিগলিতে শেয়ালের ডাক শোনা যেত। চিতাবাঘের দেখাও মিলত। শহরের চৌপথি এলাকায় ইংরেজদের জেলখানা, মহকুমাশাসকের দফতর-সহ অফিস ছিল।

প্রবীণদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, সে সময়ে শহরের জমা জল কাঁচা নালা দিয়ে গিয়ে পড়ত বিভিন্ন জলাশয়ে। সেখান থেকে জল গিয়ে পড়ত কালজানি নদীতে। ফলে, অতিবৃষ্টি হলেও শহরের জল জমার কোনও সমস্যা দেখা দিত না। আশির দশকের শেষে বক্সা ফিডার রোডের দু’ধারে বড় বড় নিকাশি নালাগুলির উপর গজিয়ে উঠছে অনেক দোকান। এতে নিকাশি নালা নিয়মিত সাফাই অসম্ভব বলে জানাচ্ছেন পুরসভার সাফাইকর্মীদের অনেকেই। তাই জঞ্জাল জমে বন্ধ হয়ে গিয়েছে নালার মুখ। উপরন্তু, যথেচ্ছ আবাসন তৈরি হচ্ছে। শহরের সূর্যনগর, বিএম ক্লাব মাঠ লাগোয়া এলাকা, মধ্যপাড়া, অরবিন্দনগর, আনন্দনগর-সহ বিভিন্ন এলাকায় বর্ষার জমা জলে দুর্ভোগ ফি বছরের ঘটনা। অনেক এলাকায় টানা তিন দিনও জল জমে থাকে।

আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চের সম্পাদক ল্যারি বসু বলেন, “নিকাশি ব্যবস্থা ঠিক না হলে আগামী দিনে আলিপুরদুয়ার টানা সাত-আট দিন জলবন্দি হয়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। মনে রাখা দরকার, শহরের গা ছুঁয়ে কালজানি ও গরম নদী বইছে। নদী থেকে শহরকে রক্ষার জন্য রয়েছে উচু বাঁধ। বর্ষায় নদীর জল বাড়লে শহরের নিকাশির জল বের করার স্লুইস গেটগুলি বন্ধ করতে হয়। তা না হলে নদীর জল উল্টে শহরের ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। বর্ষায় নিকাশি বন্ধ রাখলে জলবন্দি হয়ে পড়তে হয়।” ল্যারিবাবু জানান, শহরের বাবুপাড়া, ১৩ নম্বর ওয়ার্ড, ২ নম্বর ওয়ার্ড সহ বেশ কিছু এলাকায় এখনও জলাশয় রয়েছে। তবে তা সংস্কারের অভাবে মজে যাচ্ছে। পুরসভা ও প্রশাসন তত্‌পর না হলে আগামী দিনে ওই সব জলাশয় বুজিয়েও বহুতল গড়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন শহরবাসীদের অনেকেই।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন