জুয়ায় বাধা, জলপাইগুড়িতে পিটিয়ে খুন ব্যবসায়ীকে

প্রতিবাদের মাসুল খুন। বামনগাছি, সালকিয়ার পরে এ বার জলপাইগুড়ি। ফের উঠল অভিযুক্তদের সঙ্গে শাসক দলের যোগাযোগের অভিযোগও। বাজারে জুয়ার আসর বসানোর প্রতিবাদ করেছিলেন জলপাইগুড়ির মালকানি হাটের বাসিন্দা স্বপন সরকার (৪৫)। সেই রোষেই শুক্রবার রাতে দুষ্কৃতীরা ওই ব্যবসায়ীকে লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে খুন করে বলে অভিযোগ। রবিবার বিকেলে জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে ছ’জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৪
Share:

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্বপনবাবুর স্ত্রী বাসন্তীদেবী ও ছেলে কৃষ্ণ। —নিজস্ব চিত্র।

প্রতিবাদের মাসুল খুন। বামনগাছি, সালকিয়ার পরে এ বার জলপাইগুড়ি। ফের উঠল অভিযুক্তদের সঙ্গে শাসক দলের যোগাযোগের অভিযোগও।

Advertisement

বাজারে জুয়ার আসর বসানোর প্রতিবাদ করেছিলেন জলপাইগুড়ির মালকানি হাটের বাসিন্দা স্বপন সরকার (৪৫)। সেই রোষেই শুক্রবার রাতে দুষ্কৃতীরা ওই ব্যবসায়ীকে লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে খুন করে বলে অভিযোগ। রবিবার বিকেলে জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে ছ’জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। নিহত স্বপনবাবু বিজেপি-র যুব মোর্চার প্রাথমিক সদস্য ছিলেন। অন্য দিকে, অভিযুক্তদের একাংশ এলাকার এক তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠ বলে অভিযোগ। এমনকী, মারপিটের গোড়ার দিকে এলাকার তৃণমূল নেতা তথ্য পঞ্চায়েত সদস্য পরিমল রায় ঘটনাস্থলে গিয়ে সালিশিও করেন বলে অভিযোগ। পরিমলবাবু ফিরে যাওয়ার পরে ফের গোলমাল বাধলে স্বপনবাবুকে পিটিয়ে মারা হয় বলে অভিযোগ। ফলে, ওই তৃণমূল নেতার ভূমিকাও খতিয়ে দেখার দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।

অভিযুক্তেরা পলাতক বলে পুলিশের দাবি। জেলা পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, “জুয়ার আসরের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এক জন খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ পেয়েছি। দুষ্কৃতীদের খোঁজে মালকানি হাট সংলগ্ন এলাকায় তল্লাশি চলছে। সেখানে মদ-জুয়ার ঠেক থাকলে ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।”

Advertisement

শুক্রবার রাত পৌনে ১০টা নাগাদ মুরগির ব্যবসায়ী স্বপনবাবু নিজের দোকান বন্ধ করে প্রামাণিক পাড়ার বাড়ির দিকে রওনা হন। ওই সময় হাটের এক কোণে মোমবাতি জ্বেলে জুয়ার আসর চলছিল। অভিযোগ, সেটা দেখে প্রতিবাদ জানালে দুষ্কৃতীদের সঙ্গে স্বপনবাবুর বচসা বাধে। দুষ্কৃতীরা চ্যালেঞ্জ জানালে তিনি জুয়ার আসরের তাস ছিঁড়ে ফেলেন। স্থানীয় হাট ব্যবসায়ীদের কয়েক জন জানান, হইচই শুনে তাঁরা মনে করেছিলেন মাতালদের গোলমাল। তাই কেউ সেখানে না-গিয়ে দোকান বন্ধ করে যে যার মতো বাড়ির দিকে রওনা দেন। ওই সময় বাজারে ছিলেন পঞ্চায়েত সদস্য পরিমলবাবু। তিনি বলেন, “চেঁচামেচি শুনে বাজারে যাই। গিয়ে দেখি স্বপন জুয়ার বোর্ড উল্টে দিয়েছে। ওঁকে বুঝিয়ে পর দিন পুলিশে জানাব বলে চলে এসেছিলাম। কোনও সালিশি করিনি। পরে রাতে ফের গোলমাল শুনে গিয়ে দেখি স্বপন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তখন ওঁকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।”

প্রত্যক্ষদর্শী হাটের এক ব্যবসায়ী জানান, পঞ্চায়েত সদস্য চলে যাওয়ার কিছু ক্ষণ পরে স্বপনবাবুকে ঘিরে ধরে লাঠি ও লোহার রড দিয়ে মারতে শুরু করে দুষ্কৃতীরা। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কয়েক জন ব্যবসায়ী দৌড়ে গেলে দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে একমাত্র ছেলে কৃষ্ণ সরকারকে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বপনবাবুর স্ত্রী বাসন্তীদেবী। তাঁরা স্বপনবাবুকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। রাতেই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে স্বপনবাবু মারা যান। বাসন্তীদেবী বলেন, “হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় মলিন্দ্র সরকার, সুশান্ত রায়, রতন সরকার, রবি রায়, তাপস নন্দী ও নরেশ রায়ের নাম বলে গিয়েছেন আমার স্বামী। পুলিশকে তা জানিয়েছি।” বাসন্তীদেবীর আক্ষেপ, “জুয়া নিয়ে এর আগেও কয়েক বার স্বামীর সঙ্গে হাটের কয়েক জনের ঝামেলা হয়েছে। কত বার বলেছি, এ সবে যেও না। শুনতো না।” এলাকায় নেশা-জুয়ার প্রতিবাদ করে এর আগে উত্তর চব্বিশ পরগনার বামনগাছিতে প্রাণ দিয়েছিলেন কলেজ ছাত্র সৌরভ চৌধুরী। হাওড়ার সালকিয়াতেও ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় দুষ্কৃতীরা পিটিয়ে খুন করে স্থানীয় বাসিন্দা অরূপ ভান্ডারিকে। দু’ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের সঙ্গে শাসক দলের যোগাযোগের অভিযোগ উঠেছিল। এ ক্ষেত্রেও অভিযুক্তদের অন্তত তিন জন এলাকায় তৃণমূলের মিটিং-মিছিলে সামনের সারিতে থাকে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি। তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য পরিমলবাবু বলেন, “অভিযুক্তদের সঙ্গে আমার বা দলের ঘনিষ্ঠতা নেই।”

শনিবার জলপাইগুড়ি হাসপাতালে মৃত ব্যবসায়ীর ময়নাতদন্ত হয়। রাতে দেহ গ্রামে নিয়ে শেষকৃত্য করার পরে রবিবার কোতোয়ালি থানায় ছয় জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেন স্ত্রী বাসন্তীদেবী ও ছেলে কৃষ্ণ। শিলিগুড়ির একটি হোটেলের কর্মী কৃষ্ণ জানান, বাজারে জুয়া ও মদের ঠেক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার সমস্যা হচ্ছিল। আগেও ব্যবসায়ীরা পুলিশকে এ কথা জানান। মালকানি হাট ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক তারানাথ রায় বলেন, “পুলিশ তল্লাশি চালানোর পরে প্রকাশ্যে মদ বিক্রি এবং জুয়ার ঠেক বন্ধ হয়। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতে রাতে ফের তাসের আসর বসতে শুরু করে। পুলিশের কাছে হাটের নিরাপত্তা বাড়ানোর আর্জি জানাবো আমরা।”

স্বপনবাবুকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছে বিজেপি। দুষ্কৃতীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে খারিজা বেরুবাড়ি-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় আন্দোলনের ডাক দিয়েছে তারা। দলের যুব সংগঠনের জেলা সভাপতি জয়ন্ত চক্রবর্তী বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে ওই দুষ্কৃতীরা জুয়া মদের কারবার করে চলেছে। শুক্রবার বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে। দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ আন্দোলন করা হচ্ছে।” কংগ্রেসের জেলা সভাপতি নির্মল ঘোষ দস্তিদারও বলেন, “ঘটনার প্রতিবাদে প্রত্যেকের রাস্তায় নামা উচিত।” সিপিএম জেলা সম্পাদক সলিল আচার্যের মন্তব্য, “দুষ্কৃতীদের সাহস কোথায় পৌঁছেছে, শুক্রবারের ঘটনা তার প্রমাণ।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী, “ঘটনাটি মানা যায় না। দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ সুপারকে বলেছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন