পুজোর বাকি আর মাত্র দুই মাস। স্কুলের সহপাঠীরা এখন থেকেই জামাকাপড় কেনাকেটা, পুজোর ঘোরা নিয়ে সময় পেলেই আলোচনা জুড়ে দিচ্ছিল। আর সেই সময় বিষণ্ণ মনে একাই একাই কখনও ক্লাসে বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে থাকছিল দশম শ্রেণির পড়ুয়া, দুঃস্থ পরিবারের এক ছাত্রী। আবার কখনও সে বন্ধুদের ছেড়ে স্কুলের মাঠের কোণে একাই বসে থাকছিল। স্কুল ছুটির পর সকলে বাড়ি ফেরার তাড়া দেখালেও বাড়ি যেতে যেন মন চাইত না ছাত্রীটির। স্কুলের সহপাঠী তথা প্রতিবেশী বন্ধুরা বিকালে খেলাধূলা করলেও সে খুব একটা বাড়ি থেকে বার হচ্ছিল না।
এতেই খটকা লাগে ওই কিশোরীর সহপাঠীদের। অনেক জোরাজুরি, খোঁচাখুচির পর চলতি সপ্তাহের প্রথমেই বন্ধুদের সে জানায়, বাবা-মা বিয়ে ঠিক করে দিয়েছে। কাল, শনিবার তার বিয়ে। এর পরে স্বামীর সঙ্গে হয়ত চলে যেতে হবে বেঙ্গালুরুতে। কিন্তু সে বিয়েতে রাজি নয়। পড়াশুনো করতে চায়। বান্ধবীর মুখের এই করুণ আর্তি শুনে একজোট হয়ে যায় তার সহপাঠীরা। তার পরে রীতিমত দলবেঁধে স্কুল ছুটির ফাঁকে বিডিও অফিসে গিয়ে লিখিত আর্জি জমা দেয়। পুলিশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। শেষে প্রশাসনিক আধিকারিকদের তৎপরতায় বিয়ে আটকানো হল ওই নাবালিকার। খুশির হাওয়া ছড়িয়ে পড়ল কিশোরীর সহপাঠীদের মধ্যে।
বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ি মহকুমার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের রাববিটা এলাকার ঘটনা। ওই ছাত্রছাত্রীরা সকলেই স্থানীয় নজরুল শতবার্ষিকী বিদ্যালয়ের পড়ুয়া। তাদের এই উদ্যোগে অভিভূত স্থানীয় বিডিও বীরুপাক্ষ মিত্রও। বিডিও বলেন, “ওইটুকু ছেলেমেয়েরা যা করল তা ভাবা যায় না। ওরা বন্ধুর বিয়ে আটকানোর জন্য লিখিত আবেদনপত্রও নিয়ে এসেছিল। আমরা কিশোরীর বাবা-মা’কে বুঝিয়েছি। নাবালিকার বিয়ে বন্ধ হয়েছে। মেয়ের ১৮ বছর বয়স অবধি তাঁরা বিয়ে দেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।” বিডিও জানান, আমরা সরকরের কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রচারের জন্য স্কুলে স্কুলে যাই। সেখানে নাবালিকা বিবাহ বেআইনি তা ছাত্রছাত্রীদের বোঝানো হয়। এই ঘটনার পর ব্লকের সমস্ত স্কুলে আরও বেশি প্রচার অভিযান চালানো হবে। ওই পড়ুয়াদের পুরস্কৃত করা যায় কি না তা দেখা হচ্ছে।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বুধবার দুপুরের স্কুলের টিফিনে সময় ১০-১২ জন স্কুল পড়ুয়াকে স্কুলের পোশাকে ব্লক অফিসে ঘোরাঘুরি করতে দেখেন অনেকেই। কয়েকজন তাদের ডেকে কী দরকার জিজ্ঞাসাও করেন। পড়ুয়ারা জানিয়ে দেয়, তারা বিডিও-র সঙ্গে দেখা করতে চান। বিষয়টি জানার পর বিডিও চেম্বারে তাদের ডেকে পাঠান। ঘরে ঢুকেই পড়ুয়ারা বিডিও হাতে সকলের সই করা একটি আবেদনপত্র তুলে দেয়। তা দেখেই বিডিও-সহ অন্য অফিসারেরা কার্যত চমকে ওঠেন। চিঠিতে বন্ধুর বিয়ের উদ্যোগের যাবতীয় তথ্য দিয়ে তা বন্ধ করার আবেদন জানানো হয়। রাতের মধ্যে প্রশাসনের তরফে পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়।
এ দিন সকালেই সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে বিডিও অফিসে গাড়িতে কিশোরী এবং তার বাবা-মা’কে নিয়ে আসা হয়। কিশোরীর বাবা পেশায় কাঠমিস্ত্রি। সেখানেই জানা যায়, রাবভিটার বাসিন্দা কিশোরীর বয়স ১৪ বছর ৬ মাস। আগামীবার সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। ছিলেন ফাঁসিদেওয়া থানার ওসি কেনেথ ফোনিং-ও। ঘটনাচক্রে সে সময় ব্লক অফিসে যান মহকুমা শাসক দীপাপ প্রিয়াও। কিশোরীর বাবা মা জানান, পাত্রের বয়স ১৯ বছর। সে কোচবিহারের মাথাভাঙায় বাসিন্দা। তবে আপাতত বেঙ্গালুরুতে একটি সংস্থার অধীনে কাজ করে। এক মাস ধরে কথাবার্তা বলার পর বিয়ে ঠিক হয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের তরফে ওই দম্পতিকে নাবালিকা বিয়ে বেআইনি বলে জানিয়ে প্রয়োজনে আইনমত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। শেষে কিশোরীর বাবা মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে জানিয়ে দেন। এলাকার লোকজনের মাধ্যমে পাত্রপক্ষকেও খবর পাঠানোর ব্যবস্থা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, “পাত্রপক্ষ বিয়ের জন্য কিশোরীর বাবাকে ১ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। তা কেন হবে, সেটাও পুলিশ-প্রশাসনের দেখা দরকার।” এই ব্যাপারে বিডিও বলেন, “আমরাও ওই অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি দেখা হচ্ছে। কিশোরীকে কন্যাশ্রীর প্রকল্পের জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে।”