বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বহিরাগতেরা। বাবু মিশ্র (হাতে লাঠি), অনুপ কর (সাদা কালো টি শার্ট) দের বিরুদ্ধে অভিযোগও করে সিপি। —নিজস্ব চিত্র।
মাস চারেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি মিলেছে। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে নাম বদলে হয়েছে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এখনও অধ্যক্ষ নিগ্রহ থেকে বোমা-গুলি নিয়ে হামলার অভিযোগ, রক্তপাত পিছু ছাড়ছে না কলেজের। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থাকার সময়, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকবার অধ্যক্ষ নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল।
বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গুলি ছুড়ে, দেদার বোমাবাজি চালিয়ে ঘণ্টা দেড়েকের তাণ্ডবের পরে ক্ষুব্ধ কলেজের প্রাক্তনী ও রায়গঞ্জের সাধারণ বাসিন্দারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফেরাতে নাগরিক কনভেনশন ডাকার দাবিও তুলেছেন শহরের বিদ্বজ্জনেদের অনেকেই। বাসিন্দাদের দাবি, এই ধরনেরে হামলা রুখতে পুলিশ, প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই দাবিকে জোরদার করতেই নাগরিক কনভেনশন ডাকার প্রস্তাব উঠতে শুরু করেছে।
চলতি মাসেই গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। গত ১০ অগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র পরিষদ ও টিএমসিপি সমর্থকদের মধ্যে গোলমালে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার পর বহিরাগতদের প্রবেশ রুখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কড়া ব্যবস্থা নিলে এদিন ফের নতুন করে হামলার ঘটনা ঘটে। সে বারই প্রথম নয়, ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিলীপ দে সরকারকে কলেজ চত্বরেই নিগ্রহ করার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল ও টিএমসিপি সমর্থকদের বিরুদ্ধে। তারপরেও একাধিকবার নানা অভিযোগে উত্তাল হয়েছে কলেজ চত্বর। এ দিনের ঘটনা জেনে মর্মাহত দিলীপবাবু। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের মধ্যে নিরপেক্ষতা না আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের দ্বারা গুলি ও বোমা নিয়ে হামলার ঘটনা বন্ধ হবে না। সেই সঙ্গে, প্রশাসনকেও শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে।’’ তাঁর যুক্তি, গত ১০ অগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা হলে এদিন নতুন করে গোলমালের ঘটনা ঘটত না।
ইটাহারের প্রাক্তন সিপিআই বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘শাসক দলের চাপে পুলিশ ও প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারছে না। চোখের সামনে গুলি বোমা নিয়ে হামলা চললেও শাসক দলের সমর্থক হওয়ায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না। এরকম চলতে থাকলে কোনওদিনও রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে না।’’
ইটাহারের ডক্টর মেঘনাদ সাহা কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষা স্বপ্না মুখোপাধ্যায়কেও বছর দুয়েক আগে কলেজ চত্বরেই নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল ও টিএমসিপির নেতা ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এ দিন স্বপ্নাদেবীর অভিযোগ, ‘‘পুলিশ, প্রশাসন ও রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শাসক দলের সঙ্গে মিলেমিশে একেকার হয়ে গিয়েছে। তারই জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর পর হামলা ও গোলমালের ঘটনা ঘটছে।’’
অন্য দিকে, রায়গঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্তের অভিযোগ, ‘‘প্রতিটি ঘটনাতেই পুলিশের সামনে ছাত্র পরিষদ সমর্থকদের উপর গুলি ও বোমা নিয়ে হামলা হচ্ছে। পুলিশ, প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি অমল আচার্যের পাল্টা দাবি, ‘‘তৃণমূল শিক্ষা ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশই আমরা চাই। বিরোধীরাই শিক্ষাক্ষেত্রকে বারবার রাজনীতির জায়গায় পরিণত করেছে।’’
রাজনীতির অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘নৈরাজ্য’ মুক্ত করতে সওয়াল করেছেন শহরের বিশিষ্টরা। রায়গঞ্জ করোনেশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স মাত্র সাড়ে চার মাস। গোটা শিক্ষক সমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রক্তপাত বন্ধ করে, শিক্ষাচর্চার পরিবেশ তৈরি করতে বাসিন্দাদের জোটবদ্ধ হতে হবে।’’
শুধু শিক্ষাবিদ নয়, প্রতিক্রিয়া হয়েছে সমাজের অন্য স্তরেও। চিকিৎসক জয়ন্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ছাত্র রাজনীতি নিশ্চই থাকবে, কিন্তু তাতে হিংসা থাকবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের পরে পড়াশোনা শুরু হওয়ার আগেই, এমন এক অবস্থা চলছে, যা নিয়ে কী মন্তব্য করব তাই বুঝতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণা কেন্দ্র, এখানে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সাধারণ নাগরিক কনভেনশন করা হোক।’’ নাট্যব্যক্তিত্ব অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হালের জন্য আমি প্রশাসনের চরম ব্যর্থতাকেই দায়ী করব। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হওয়ায়, যা ঘটছে তাতে আমি মর্মাহত, আতঙ্কিত। আমার মনে হয়, বোধবুদ্ধি সম্পন্ন সংস্কৃতিপ্রপেমী সকলের এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামা উচিত।’’ আরেক নাট্যকর্মী প্রণব বসাকের দাবি, ‘‘ভবিষ্যতে গুলি ও বোমা নিয়ে হামলা বা সংঘর্ষের ঘটনা রুখতে অবিলম্বে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে নিরপেক্ষভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’’ রায়গঞ্জ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও পশ্চিম দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের সম্পাদক অতনুবন্ধু লাহিড়ীর দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ বা হামলার ঘটনা চলতে থাকলে শহরবাসীর মধ্যেও আতঙ্ক থাকবে।