বন্ধ কারখানায় স্তব্ধ কোচবিহারের সমৃদ্ধির স্বপ্ন

বাণিজ্যে বাস করেন লক্ষ্মী। কোচবিহারের রাজবাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ম্লান হয়ে এলে, নতুন শিল্পকেন্দ্রকে ঘিরে ফের শ্রী ফিরে পেতে চেয়েছিল এককালের ‘রাজনগর।’ একটা সময়ে ‘রাজনগর’ কোচবিহার কতটা জমজমাট ছিল তা নিয়ে রাজ আমলের নানা প্রামাণ্য নথি রয়েছে। রাজার আমল যাওয়ার পরে শহরের কৌলিন্যও যেন ধীরে ধীরে হারাচ্ছে। বাম আমলে শহরের উপকণ্ঠে চকচকা এলাকায় যে শিল্পকেন্দ্র গড়ে ওঠে তা নিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিল কোচবিহার। কিন্তু, বাম-জমানায় গোড়াতেই তা হোঁচট খেল।

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ

কোচবিহার শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৪ ০৩:২৫
Share:

পাঁচিলে জমেছে শ্যাওলা। গেটে ঝুলছে তালা। চকচকা শিল্পকেন্দ্রে হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।

বাণিজ্যে বাস করেন লক্ষ্মী। কোচবিহারের রাজবাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ম্লান হয়ে এলে, নতুন শিল্পকেন্দ্রকে ঘিরে ফের শ্রী ফিরে পেতে চেয়েছিল এককালের ‘রাজনগর।’

Advertisement

একটা সময়ে ‘রাজনগর’ কোচবিহার কতটা জমজমাট ছিল তা নিয়ে রাজ আমলের নানা প্রামাণ্য নথি রয়েছে। রাজার আমল যাওয়ার পরে শহরের কৌলিন্যও যেন ধীরে ধীরে হারাচ্ছে। বাম আমলে শহরের উপকণ্ঠে চকচকা এলাকায় যে শিল্পকেন্দ্র গড়ে ওঠে তা নিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিল কোচবিহার। কিন্তু, বাম-জমানায় গোড়াতেই তা হোঁচট খেল। চকচকায় ঠিকঠাক পরিকাঠামো তৈরি হল না। রাস্তাঘাট, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, জল-সহ নানা সমস্যা মেটানো নিয়ে টালবাহানায় জেরবার হলেন উদ্যোগীদের অনেকে। ফলে, যেখানে ৬৫টি কারখানা গড়ে উঠেছিল তার অনেকগুলিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন ৪৮টি মাঝারি, ছোট মাপের কারখানা চলছে। তাও শিল্পোদ্যোগীরা নানা ঝঞ্ঝাটে জেরবার।

একটু অতীতে চোখ ফেরানো যাক। কৃষি নির্ভর কোচবিহারে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে বাম জমানায় কোচবিহারে শিল্পকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগে শহর লাগোয়া চকচকায় শিল্পকেন্দ্রটি চালু হয়। খোদ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সেই সময় ১২টি কারখানার শিলান্যাস করেন। ৭২ একর জমির ওপর তৈরি ওই এলাকায় কয়েক বছরের মধ্যে রাইস মিল, হাসকিং মিল, প্লাস্টিক সামগ্রী, খাতা তৈরি, সরষের তেলের মিল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পাটজাত ও তুলোজাত সামগ্রী, বিস্কুট, মশারি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি-সহ মোট ৬৫টি কারখানা তৈরি হয়। যার মধ্যে একটি একটি করে অন্তত ১৭টি কারখানা বন্ধ হয়ে রয়েছে। ওই তালিকায় থাকা মশারি তৈরির কারখানাটি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ হয়ে রয়েছে। তুলোজাত সামগ্রী, বিস্কুট, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বিভিন্ন কারখানাগুলির এমন অবস্থাও দীর্ঘদিনের। বেশ কিছু বন্ধ কারখানার ঘর, অন্য পরিকাঠামো গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। রাজ্য শিল্প উন্নয়ন নিগমের তরফে সমস্যা খতিয়ে দেখে ওই সব বন্ধ কারখানা নতুন করে চালুর ব্যাপারে সেভাবে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।

Advertisement

কিছুদিন আগে কোচবিহার জেলা প্রশাসনের তরফে বৈঠক করে চকচকার সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়। সেখানে কারখানার নামে জমি আটকে রাখার প্রবণতা বন্ধে কড়া মনোভাবের কথা বুঝিয়ে দেন প্রশাসনের কর্তারা। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই বৈঠকে দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকেন্দ্র চত্বরে বন্ধ পড়ে থাকা কারখানা চালু না করা হলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার লিজ বাতিল করে জমি ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সওয়াল করেন প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা। তবে তার আগে বন্ধ কারখানা কর্তাদের অবশ্য সুযোগ দিতে চাইছেন তারা। শিল্প নিগমের কর্তাদের বন্ধ কারখানা কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা খতিয়ে দেখে দ্রুত সেগুলি চালুর ব্যাপারে উসাহ বাড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর পর নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। কাজ না হলে কিংবা কোনও সংস্থা বন্ধ কারখানা খোলার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখালে নিয়মমাফিক আইনি নোটিস পাঠিয়ে জমির লিজ বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন বলেন, বন্ধ কারখানা চালু না করে জমি আটকে রাখা যাবে না।

কেন এমন পরিস্থিতি? চকচকার শিল্পোদ্যোগী ও ব্যবসায়ী সংগঠন কর্তাদের বক্তব্য, প্রথমত উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে শিল্পোদ্যোগীরা কর ছাড়ের সুযোগ পান। উত্তরবঙ্গে সেই সুযোগ নেই। ওই ব্যাপারে কেন্দ্রের কাছে দরবার করেও লাভ হয়নি। চকচকা শিল্পকেন্দ্রের সঙ্গে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক সংযোগকারী রাস্তার বেহাল দশা। সন্ধ্যের পর শিল্পকেন্দ্র চত্বরের বেশির ভাগ পথবাতি মাঝেমধ্যে বিকল হয়ে থাকছে। নিকাশির অবস্থা আরও খারাপ। সামান্য বৃষ্টিতে জলে ভাসে গোটা চত্বর। তার উপরে রয়েছে লোডশেডিং ও লো ভোল্টেজের সমস্যাও।

নিরাপত্তা নিয়েও ক্ষোভ কম নয়। বারবার দরবার করেও সেখানে পুলিশ পিকেটের দাবি পূরণ হয়নি। অসমের অশান্তি থেকে উত্তরবঙ্গ ঘিরে নানা বিক্ষিপ্ত আন্দোলন জনিত সমস্যাও উপাদিত সামগ্রী বিক্রির বাজারের ওপর প্রভাব ফেলছে। কোচবিহারের বাজার দখল করেছে অন্যত্র উৎপাদিত সামগ্রী। তার ওপর এতদিনেও গোটা শিল্পকেন্দ্রে কোনও বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠেনি। একটি মাঝারি ছাড়া সবই ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র। এমনকী, জুট পার্কের জন্য ২০০৭ সালে সরকারি ভাবে সিদ্ধান্ত হলেও কাজ হয়নি। অথচ জেলায় দেদার পাট উপাদন হয়। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি চটজাত সামগ্রী তৈরিতে কাঁচামালের অভাব হতো না। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ত। কিন্তু উদ্যোগটা কোথায়? কোচবিহার ডিস্ট্রিক্ট ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ওয়েলফেয়ার আসোসিয়েশনের সভাপতি সুকুমার সাহা বলেন, “পরিকাঠামো হয়নি। উড়ান বন্ধ। কেন্দ্র কর ছাড়ের সুযোগ দিচ্ছে না। এ সব নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। কাজের কাজ করতে হবে।”

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন