ইউরোপিয়ান ক্লাবের মাঠে এখন সরকারি আবাসন। দীপঙ্কর ঘটকের তোলা ছবি।
চা বাগান ঘেরা ছবির মতো শহর। মালবাজার তাই বরাবর সকলের কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু, মালবাজারের অন্য পরিচয়ও রয়েছে। সেটা হল প্রতিবাদী হিসেবে পরিচিতি।
যেমন ১৯৩৮ সালের কথা ধরা যাক। সে বছর মূলত মালবাজারকে কেন্দ্র করেই বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলন উত্তরবঙ্গে দানা বাঁধে। নেতৃত্ব দেন মালবাজারের সেই সময়ের বাসিন্দা দেবপ্রসাদ ঘোষ ওরফে পটল ঘোষ। পটলবাবু রাজ্য বামপন্থী নেতৃত্বদের কাছেও ছিলেন পরিচিত মুখ। এই সময়েই রেলকর্মীদের ইউনিয়ন গঠিত হয়। পরে যে সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে দোমহনিতে গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু।
এর পরে ১৯৪৫-এ বামপন্থীরা মালবাজারের ডাকবাংলো ময়দানে বিরাট প্রকাশ্য সম্মেলন করেন। কেন্দ্রীয় ভাবে চা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়। চা শ্রমিক আন্দোলনের জন্যে সংগঠিত শ্রমিক ইউনিয়ন প্রথম সভা হিসাবে এককথায় ইতিহাস রচনা করে। মালবাজারের ডাকবাংলো ময়দানের এই সভায় চা শ্রমিক সংগঠন তৈরির ক্ষেত্রে যে মালবাজারই পুরোধার কাজ করে বলে চা শ্রমিক মহলের অনেকেই মানছেন। ওই ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন পটল ঘোষ এবং সভাপতি হন রতনলাল ব্রাক্ষণ।
ওই সময়টায় তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জনপদের মতই মালবাজারেও। তেভাগা আন্দোলনেও অন্যতম জায়গা দখল করে মালবাজারে গিয়ে আন্দোলনের গান শুনিয়ে যেতেন মেটেলির বাসিন্দা লাল শুকরা ওঁরাও। আন্দোলনকে গানে ছড়িয়ে দেওয়ার তাঁর উদ্যোগের সঙ্গে তুলনা চলত চারণকবি মুকুন্দ দাসেরনিজস্ব স্বকীয়তায় তিনি গানের মাধ্যমে জমির ফসলের অধিকার জানাতেন কৃষকদের। চাষিদের স্মৃতিচারণায় সে গান উঠেও আসে। তার কথা এরকম: ‘মালবাজার আনা যানা/ মাটিয়ালি থানা রে/ শুনো ভাই স্বাধীন দেশকা গানা রে/ এক বিতা পেট লিগিন/ গিলি জেল খানারে/ শুনো ভাই স্বাধীন দেশকা গানা রে।’
চল্লিশের দশকের মাঝামাঝিতে মালবাজারে বাবার রেলের চাকরির সুবাদে থাকতে শুরু করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। রেল স্টেশনের কাছেই কোনও একটা কোয়ার্টারে থাকতেন তাঁরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের যুদ্ধ বিমান ভেঙে পড়ে মালবাজার শহরের ইউরোপিয়ান ক্লাবের মাঠেই। কিশোর শীর্ষেন্দু ক্রিকেট বল খুঁজতে গিয়ে সেই বিমানের ধ্বংসস্তূপের নিচে তিনটি চিতাবাঘের ছানা দেখতে পেয়েছিলেন। সেই গল্প তিনি একাধিকবার নানা জায়গাতেও লিখেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সেই মাঠে এখন ১২টি চার তলা বাড়ি। সরকারি আবাসন তৈরি হয়েছে ত্রিশ বছর আগে। কাছেই মালবাজার রেল স্টেশন।
অবিভক্ত ভারতের উত্তরবঙ্গে অন্যতম বড় রেল স্টেশন মালবাজার। রেল তখন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে বেঙ্গল ব্রিটিশ রেলওয়েজ কোম্পানি। মালবাজার থেকে নানা প্রান্তে রেল চলত। ট্রেন উঠে যেত পাহাড়ের ওপরের মেটেলিতেও। এখন মালবাজার স্টেশনের হতশ্রী দশা। তিন বছর আগে মিটারগেজ তুলে দিয়ে আশা জাগিয়ে চ্যাংরাবান্ধা, মালবাজার রেলপথ বসেছে। কিন্তু, কবে থেকে ট্রেন চলবে তা স্পষ্ট নয়। এখন শহরের স্টেশন বলতে পুর এলাকার থেকে দু’কিলোমিটার দূরের নিউ মাল জংশন।
যে শহর আজ থেকে ৬০ বছর আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের অন্যতম পুরোধা ছিল। দলমত নির্বিশেষে এলাকার প্রবীণদের অনেকেই স্বীকার করেন, সত্তর দশকে অকৃতদার পরিমল মিত্রই মালবাজার থেকে উঠে আসা রাজ্য রাজনীতিতে শক্তপোক্ত জায়গা করতে পেরেছিলেন। ১৯৭৭ সালে বাম সরকার প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রথম বাম মন্ত্রিসভায় তিনি হন বনমন্ত্রী। সেই সময়েই বন দফতরের উদ্যান ও কানন বিভাগকে দিয়ে মালবাজারে তিনি মালবাজার উদ্যান তৈরি করেন। যা আজও মালবাজারের গর্বের কারণ। মালবাজার কলেজ তৈরিতেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য বলে মানেন এলাকাবাসীদের প্রায় সকলেই।
তবে পরিমলবাবুর পরে মালবাজার থেকে গিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে বড় মাপের জায়গা করে নেওয়ার মতো রাজনীতিকের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা। এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জেলার রাজনীতিতে ছাপ ফেলছেন। উত্তরবঙ্গ জুড়ে হয়তো প্রভাব পড়ছে। কিন্তু, মালবাজারের থমকে যাওয়ায় নানা উন্নয়ন চালু করাতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে জনমানসেই।
সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ-অভিযোগ রয়েছে মালবাজার মহকুমার পরিকাঠামো নিয়ে।
(চলবে)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-শহরের নাম’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর-শহরের নাম’,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৬/৮৯ চার্চ রোড, শিলিগুড়ি ৭৩৪০০১