বালুরঘাট বুড়াকালি বাজারে পড়ে রয়েছে খোকন কর্মকারের দেহ। ছবি: অমিত মোহান্ত।
তোলাবাজদের পান্ডা সন্দেহে ভর সন্ধ্যায় বাজারের মধ্যে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে, কুপিয়ে মারল ক্ষিপ্ত জনতা। বুধবার সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ বালুরঘাট শহরের বুড়াকালি মন্দিরের সামনে ওই ঘটনায় নিহতের নাম খোকন কর্মকার (৪৪)। গীতাঞ্জলি বাজারপাড়ার বাসিন্দা খোকনের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় হুমকি, তোলাবাজি-সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একদল লোক খোকনকে তাড়া করে প্রথমে বাঁশ ও রড দিয়ে এলোপাথাড়ি পেটায়। এর পরে বঁটি দিয়ে গলা ও মাথায় কোপ দিয়ে তাকে খুন করা হয়। এই ঘটনাকে ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোরও।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, এ দিন সকালে বালুরঘাটের মাছ ও সব্জি বাজারে কয়েক জন যুবক মদ্যপ অবস্থায় তোলা আদায় করছিল। সে সময়ে ব্যবসায়ীরা কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। তারা চলে যাওয়ার পরে দুপুরে তা নিয়ে বাজারে ক্ষোভ দানা বাঁধে। বিকেলে ফের তোলা আদায় করতে যায় কয়েক জন। ওই সময়ে লাঠি, ধারালো অস্ত্র, বাঁশ নিয়ে তোলাবাজদের তাড়া করা হয়। দুষ্কৃতীরা ভয়ে পালায়। সেই সময় এক সন্দেহভাজন তোলাবাজের বাড়ি ভাঙচুর করে জনতা। ফেরার সময়ে একটি গলিতে খোকনকে দেখতে পায় উত্তেজিত জনতা। লাঠিসোটা নিয়ে লোকজন তাড়া করলে খোকন প্রাণভয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, বাজারের মধ্যে বড় রাস্তায় ওঠার পরে বাঁশের আঘাতে খোকন পড়ে যায়। এর পরেই শুরু হয় গণপিটুনি। খোকনের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকে একটা দোকানের সামনে। এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পরে পুলিশ টহলদারি শুরু করে। বাজার এলাকায় র্যাফ মোতায়েন করা হয়।
ভরসন্ধ্যায় বাজারে সোনার দোকান, জামাকাপড়, জুতোর দোকানে তখন ছিল জমজমাট ভিড়। চোখের সামনে ওই খুনের ঘটনা দেখে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত জনতার একাংশকে চেঁচিয়ে অভিযোগ করতে শোনা যায়, “বছরের পর বছর তোলাবাজি করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রতিবাদ করায় বাজারের একজন ব্যবসায়ীকে বছর তিনেক আগে খুন হতে হয়েছে।” ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি, সে কারণেই এ দিন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়ে থাকতে পারে। দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার শীসরাম ঝাঝারিয়া বলেন, “নিহত ব্যক্তির নামে বেশ কিছু পুরনো অপরাধের মামলা রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক জনকে আটক করা হয়েছে। কারা তাকে খুন করল, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা কখনও উচিত নয়।”
এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, বাম আমলে ২০১১ সালের ৮ মে সকালে পরিতোষ দে নামে শহরের এক মাছ ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে খুনের ঘটনায় খোকনের নাম জড়িয়েছিল। সে সময় মাছ বাজারে তোলাবাজির প্রতিবাদ করেছিলেন পরিতোষবাবু। অভিযোগ, বামেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় সে যাত্রায় খোকনের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দেয়নি। তবে, ওই মামলাতেই গত বছর ৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সম্প্রতি তাদের মধ্যে চার জন হাইকোর্টের নির্দেশে অন্তর্বর্তী জামিনে ছাড়া পেয়েছে। ওই চার জন ইদানীং খোকনের নির্দেশে ফের মাছ বাজারে তোলা আদায় শুরু করে বলে ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ।
এলাকার সিপিএম এবং আরএসপি নেতাদের একাংশের এখন দাবি, তাঁদের সময়ে পুলিশ তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল বলেই ছ’জনের সাজা হয়। কিন্তু, ইদানীং আইনশৃঙ্খলা রুখতে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা চরমে পৌঁছনোয় জনরোষ বেড়ে গিয়েছে। বালুরঘাটের বাম নেতা তথা প্রাক্তন কারামন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরী বলেন, “রাজ্য জুড়েই বিশৃঙ্খলার পরিবেশ চলছে। বালুরঘাটের মতো শান্তিপূর্ণ শহরে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।” তবে খোকনের সিপিএম-ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বিশ্বনাথবাবুর মন্তব্য, “ও সব আমি বলতে পারব না।”
ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদল হওয়ার পরে খোকনকে তৃণমূলের মিছিলে সামিল হতেও দেখা গিয়েছে। এমনকী, গত পুরভোটে তৃণমূলের প্রচারেও তাকে দেখা গিয়েছিল। পুরসভায় তৃণমূলের জয়লাভের পর পাড়ার বিজয় মিছিলেও তাঁকে দেখেছেন অনেকে। পুরবোর্ড গঠনের পরে খোকনের দলবল বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সে কথা ফলাও করে বলে হুমকি দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েক জন ব্যবসায়ী জানান, খোকনের দলবলের কাজের প্রতিবাদ করায় বাড়িতে চড়াও হয়ে শাসিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। তৃণমূলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে দাবি করে খোকন এলাকার ব্যবসায়ীদের ভয় দেখাত বলেও অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। যদিও তৃণমূলের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্র বলেন, “খোকনকে দলে নেওয়া হবে না, সে কথা পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছিল। কারণ, ওঁর বিষয় নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে ক্ষোভ ছিল। ফলে, পুরভোটের সময় কী হয়েছে, জানা নেই। তবে নিহতের সঙ্গে দলের কোনও রকম সম্পর্ক ছিল না।”
বালুরঘাটের মাছ বাজার সহ কয়েকটি এলাকায় তোলা আদায়ের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এক দল দুষ্কৃতী বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের থেকে জবরদস্তি ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে বলে অভিযোগ। নানা সময়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি বলে একাধিক ব্যবসায়ী দাবি করেছেন। সে জন্য ২০১১ সালে রুখে দাঁড়ান পরিতোষবাবু। তার জেরে তাঁকে সাত সকালে জনবহুল রাস্তায় গুলি করে খুন করা হয়। বাম আমলে দিনের পর দিন এমন ঘটলেও পুলিশ-প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে পরিতোষবাবুকে খুন হতে হয় বলে ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ।
কিছু ব্যবসায়ীর অভিযোগ, আগে সারা দিনে একবার তোলা আদায় হতো। ইদানীং দিনে দু’বার, অর্থাৎ সকাল ও সন্ধ্যায় টাকা আদায়ের চল শুরু হয়েছে। পুলিশকে জানাতে গিয়ে অনেকেই হুমকির মুখে পড়েছেন। কয়েক জন ব্যবসায়ী এই অভিযোগও করছেন, বাম আমলে তোলা আদায়কারীদের ব্যাপারে পুলিশ ও নেতাদের একাংশকে বলেও লাভ হতো না। রাজ্যে পরিবর্তনের পরেও সেই অবস্থা পাল্টায়নি বলে তাঁদের অনেকেই মনে করছেন। বালুরঘাট শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রাজেন শীল বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে পুরসভার চেয়ারপার্সন চয়নিকা লাহার দাবি, “শহরের মাছবাজারে তোলাবাজির কোনও অভিযোগ আমাদের কাছে নেই।” বালুরঘাটা শহরেরই বাসিন্দা, রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী কলকাতা থেকে ফোনে বলেন, “খবরটা শুনলাম। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চেয়েছি। রিপোর্ট পেলে যা বলার বলব।
বুধবার সন্ধ্যায় কালীবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি সোনার দোকানের বারান্দার কোনে সাইকেলের পাশে খোকনের ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে আছে। রাস্তাতেও রক্তমাখা ভাঙা বাঁশের টুকরো পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়।