তখন মহানন্দার ধার দিয়ে অনেক দূর হেঁটে যাওয়া যেত। দু’এক বছর সরস্বতী পুজোর দিন ‘বন্ধু’র সঙ্গে মহানন্দা নদীর পাড় দিয়ে অনেকখানি পথও হেঁটেও ছিলেন ইলিনা মুখোপাধ্যায়। মধ্যবয়সী ইলিনা দেবী অন্তত ২২ বছর আগে শিলিগুড়ির পাট চুকিয়ে এখন কলকাতার মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা। নিজের শহর চেনাতে বৃহস্পতিবার সকালে অষ্টাদশী মেয়েকে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন। সেবক রোডে একটি রেস্তোরায় বসে মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, “ভ্যালেন্টাইন্স ডে হল ওদের জন্য। আমাদের সময় সরস্বতী পুজোই ছিল ভালবাসার দিন। তবে শহর এখন অনেক ঘিঞ্জি হয়েছে। চারপাশে অনেক চোখ, নজর এড়িয়ে যাওয়ার জায়গাই নেই।”
রাত পোহালেই ভালবাসার দিন। যে রেস্তোরায় বসে স্মৃতি আর আক্ষেপের কথা ইলিনা দেবী জানালেন, সেখানে ইতিমধ্যে লাল রঙের হৃদয়াকৃতির বেলুন দিয়ে সাজিয়ে ফেলা হয়েছে। রেস্তোরার পাশের শপিং মল সেজেছে কাগজের রঙিন ফুল আর টবে রাখা সবুজ অর্কিডে। প্রাক ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র ছাড়ের বিজ্ঞাপনে মলের এ প্রান্তে থেকে ও প্রান্ত ছয়লাপ। পোশাক, জুতো থেকে অলঙ্কার, চুল বাঁধার পিন সবেতেই ভালবাসার দিন উপলক্ষে ছাড়ের ঘোষণা। ১৪ ফেব্রুয়ারির জন্য রয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। কোনও মলে ফ্যাশন শো, কোথাও আবার লাইভ ব্যান্ড, ফুলের ঘেরাটোপে সঙ্গীকে নিয়ে ছবি তোলার সুযোগ। মলগুলির আয়োজনই যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, দিন বদলেছে। এখন সময়টা ভিড়ের মাঝেই ভালবাসার উদযাপনের।
গত বুধবারই সেবক রোডের মল কর্তৃপক্ষের অফিসে গিয়ে শনিবারের পুরো দিনের সূচি জেনে নিয়েছেন অর্চিস্মান-শতরূপা। ইঞ্জিনিয়ারিঙের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অর্চিস্মান, শতরূপা এবারে স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে ভর্তি হয়েছে। স্কুল থেকেই ওদের বন্ধুত্ব। শুধুই ওরা দু’জন নয়, আরও বন্ধু-বান্ধবীরা আসবে ‘ভি-ডে’ (ভ্যালেন্টাইন ডে’র সংক্ষিপ্ত) উদযাপন করতে। অর্চি-শতরূপাদের কথা ভেবেই ওই মলে আগামী শনিবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। দুপুর থেকে চলবে নানা মজাদার গেম শো। থাকবে ফুল দিয়ে সাজানো ‘ফটো জোন’। যেখানে গিয়ে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে ছবি তোলার অবাধ সুযোগ। উন্মাদনার পারদ চড়াতে আর জে অনুষ্ঠান এবং লাইভ ব্যান্ডের অনুষ্ঠান রেখেছে কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে থাকছে, নানা রকম কোর্সের রকমারি পদে খাওয়া দাওয়ারও আয়োজন।
একই রকমের আয়োজন দেখা গেল মাটিগাড়ার একটি শপিং মলেও। নতুন প্রজন্মের ভিড় টানতে তাদের অস্ত্র ফ্যাশন শো। গানের একটি সর্বভারতীয় রিয়্যালিটি শোয়ের এক সফল প্রতিযোগীর অনুষ্ঠানও থাকছে শপিং মলে। একটি নামী আইসক্রিম চেনের তরফে ভালবাসার দিনের জন্য আইসক্রিমেও নানা লোভনীয় ছাড়ের ব্যবস্থা থাকছে। ফেসবুকে সংস্থার ‘পেজ’কে লাইক করলে আরও বেশি ছাড়ের সুযোগও রয়েছে। বর্তমানে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের যুগে কার্ডের চাহিদাও যথেষ্ট রয়েছে বলে বিক্রেতাদের দাবি। এ বছর সিনেমার পোস্টারের আদলে তৈরি করা কার্ডের চাহিদা সর্বাধিক বলে জানালেন হিলকার্ট রোডের একটি নামী ব্র্যান্ডের কার্ডের শোরুমের কর্ণধার গৌতম অগ্রবাল।
কার্ড থেকে ‘ফান জোন’ সব আয়োজন নিয়ে ভালবাসার দিনকে স্বাগত জানাতে শিলিগুড়ির প্রস্তুতি আপাতত তুঙ্গে। শহরের কয়েকটি হোটেল রেস্তোরাতেও বেলুন, আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র জন্য। সব ধরনের ভাষা-ভাষী এবং বয়সের কথা মাথায় রেখেই শহরের বিভিন্ন মলে প্রেম দিবসের উদযাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
কখনও হার্ড রক কখনও আবার, পুরোনো দিনের হিন্দি বা বাংলা সিনেমার গানের আবহও বাজানোর পরিকল্পনা জানিয়েছে বেশ কয়েকটি শপিং মল কর্তৃপক্ষ। শহরের একটি মলের মার্কেটিং ম্যানেজার প্রতীক চক্রবর্তী বলেন, “এমন ভাবে সব কিছুর আয়োজন করা হয়েছে, যাতে শনিবার সারাদিনই মল চত্বরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘুরে কাটিয়ে দেওয়া যায়। শহরে এখন প্রেম করার জায়গা কম, তাই আমরা বাড়তি দায়িত্ব নিয়েছি।”
শহরের একটি মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানাল, শনিবারের জন্য টিকিটের আগাম বুকিং প্রায় শেষের পথে। বিকেল অথবা সন্ধ্যের পরের শো’য়ের টিকিট চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানা গেল। সেবক মলের শপিং মলে দেখা মেলা অর্চিস্মান-শতরূপার পরিকল্পনাও এমনই। শতরূপার কথায়, “অনেক ক’জন মিলে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত মলে কাটাব। কেনাকেটা করব, আইসক্রিম, চাইনিজ খাব। তার পরে সিনেমা দেখতে যাব। তবে সিনেমা কিন্তু শুধু দু’জনেই দেখতে যাব।” শহরের এক বিনোদন বিশেষজ্ঞের কথায়, “দিনভর সঙ্গী-সঙ্গিনীর সঙ্গে ঘোরাফেরার পরে সকলেই একটু আড়াল তো চাইবেই। তাই এখনও প্রেমিক প্রেমিকাদের সিনেমা হল-ই অন্যতম পছন্দ।” সরস্বতী পুজো থেকে ভি-ডে, কার্ড থেকে হোয়াটসঅ্যাপ, আর-জে, লাইভ ব্যান্ডউদযাপনের ধরনটাই পাল্টেছে। উষ্ণতাটা একই।