টবে স্ট্রবেরি চাষ। শিলিগুড়িতে তোলা নিজস্ব চিত্র।
লিচুর আকারের, কোনওটা তার চেয়ে বড়। লাল টকটকে। মুখে দিলেই জেলির মতো। কোনওটা খেতে একটু টক। নামও গালভরা। ‘সুইট চারলি’, ‘ফেস্টিভ্যাল, ‘ক্যামরোসা’, ‘ফ্রেসকা’ বা ‘এলান’। প্রথম বার পরীক্ষামূলক ভাবে চাষ শুরু হতেই স্ট্রবেরির ওই সমস্ত প্রজাতি আশা জুগিয়েছে অনেক চাষিকে। উত্সাহী করেছে এই চাষে।
স্ট্রবেরি চাষে উত্সাহ দিতে অগস্টে উদ্যোগী হয় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব ফ্লোরিকালচার অ্যান্ড এগ্রি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট (কোফাম)। তারা উত্সাহীদের অনেকেই ওই সমস্ত নানা প্রজাতির স্ট্রবেরিচারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিলি করেছিলেন। কোফাম থেকে সহায়তা নিয়ে শিলিগুড়ি-নকশালবাড়ি সহকৃষি অধিকর্তার এবং ফাঁসিদেওয়া-খড়িবাড়ি কৃষি অধিকর্তার দফতর চাষিদের উত্সাহ দেয়। স্ট্রবেরি চাষ করলে কেমন হয় তা হাতে কলমে করে দেখতে উদ্যোগী হন খড়িবাড়ি, নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া, মাটিগাড়া ব্লকের চাষিদের একাংশ। ভাল ফলন হওয়ায় এ বার তাঁরা ব্যবসার ভিত্তিতে আবাদ শুরু করতে চাইছেন।
সে তালিকায় শিলিগুড়ির বাসিন্দা তন্ময় চক্রবর্তী থেকে, নকশালবাড়ির অশোক দেব, আঠেরোখাইয়ের যোগেশ রায়, গজলডোবার পরিমল ঘোষদের মতো অনেকেই রয়েছেন। ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কিলোগ্রাম দরে বিক্রি হয় স্ট্রবেরি। তাই এই চাষ লাভনজক হবে বলে তাঁরা আশায় বুক বেঁধেছেন। কোমাফের দায়িত্বে থাকা রণধীর চক্রবর্তী বলেন, “স্ট্রবেরি চাষে উত্সাহী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকেই চারা নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের চাষের পদ্ধতি, নিয়ম সমস্ত বিশদে বলে দেওয়া হয়। কর্মশালাও করা হয়। অনেকেই তাতে ভাল সাড়া পেয়েছেন। আগামী বছর অনেকেই ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাদের দিক থেকেও তাঁদের সমস্ত সাহায্য করা হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা স্ট্রবেরি চাষে বিশেষজ্ঞ বব নটলম্যানকে উত্তরবঙ্গে নিয়ে আসে কোফাম। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে মাটি পরীক্ষা করে কয়েকটি প্রজাতির স্ট্রবেরি চাষ ভাল হবে বলে তিনি জানিয়ে দেন। সেই মতো ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চারা আনিয়ে তা থেকে নতুন চারা তৈরি করে চাষিদের বিলি হয়। শিলিগুড়ি-নকশালবাড়ি সহকৃষি আধিকর্তার দফতর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারা নিয়ে এলাকার ১০/১২ জন চাষিকে তা বিলি করে। অন্য দিকে ফাঁসিদেওয়া-খড়িবাড়ি সহকৃষি অধিকর্তার দফতর বেঙ্গালুরুর থেকে চারা আনায়। ৮টি ফার্মার্স ক্লাবকে তারা ৩ হাজার চারা বিলি করেন নিখরচায়। গত অক্টোবর থেকে ২/৩ দিন অন্তর আটটি ফার্মাস ক্লাব গড়ে ৩০ কিলোগ্রাম করে স্ট্রবেরি উত্পাদন করছে। এখনও গাছগুলি থেকে তারা ফলন পাচ্ছেন।
শিলিগুড়ির বাসিন্দা পরিমল ঘোষ গজলডোবায় লিজে জমি, পুকুর নিয়ে মাছ, সব্জি চাষ করেন। সেখানেই এক কাঠা জমিতে স্ট্রবেরি লাগিয়েছিলেন। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মরসুম জুড়ে ৩-৪ দিন অন্তর তিনি জমি থেকে ১ কেজি করে স্ট্রবেরি তুলেছেন। তিনি বলেন, “পরীক্ষা মূলকভাবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোফাম থেকে চারা লাগিয়েছিলাম। ভাল ফলন হয়েছে। বাড়ির লোকেরা, বন্ধু, পরিচিতদের মধ্য্যে এ বছর প্রচুর স্ট্রবেরি বিলি করেছি। ১ কিলো স্ট্রবেরি ৫০০ টাকা দাম। আগামী বছর ব্যবসায়িক ভাবে স্ট্রবেরি চাষ করব বলে ঠিক করেছি।”
নকশালবাড়ি কলেজের কাছে ভোগেলরাস জোতের বাসিন্দা অশোক দেব, আঠেরোখাইয়ের যোগেশ রায়রা শিলিগুড়ি-নকশালহবাড়ি সহ কৃষি আধিকর্তার দফতর থেকে চারা নিয়ে লাগিয়েছিলেন। অশোকবাবু মাত্র সিকি কাঠা জমিতে গাছ লাগান পরীক্ষামূলক ভাবে। অশোকবাবু বলেন, “ভাল ফল মিলেছে। আগামী মরসুমে ১০ কাঠা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করব । ভাল মতো চাষ করলে তা থেকে ২ লক্ষ টাকা আয় হবে।” বাগডোগরার বাজারে ৪০০ টাকা কেজি দরে এ বছর-ই স্ট্রবেরি বিক্রি করছেন যোগেশবাবু। অনেকে তাঁর বাড়ি থেকে এসে নিয়েও গিয়েছেন। ফাঁসিদেওয়া-খড়িবাড়ির ৮ টি ফার্মাস ক্লাব সব মিলিয়ে ২ বিঘা জমিতে চাষিদের দিয়ে চাষ করান। শিলিগুড়ির পাইকার ব্যবসায়ীরা ৩০০/৩৫০ টাকা কেজি দরে তাঁদের ফলন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছেন।
শিলিগুড়ির মাল্লাগুড়ির বাসিন্দা তন্ময় চক্রবর্তী ভিন্ন পেশার মানুষ। কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের কাজ করেন। বছর তিনেক আগে শিলিগুড়িতে একটি ফুলমেলা থেকে একটি স্ট্রবেরি চারা এনেছিলেন। দু বছর ধরে তা থেকে নিজেই চারা তৈরি করেছেন। টবে চাষ করেছেন ছাদ জুড়ে। এ বছর দারুণ ফলন হওয়ায় তিনি ব্যবসায়িক ভাবে চাষের জন্য জমি খুঁজছেন। মাটিগাড়ার-নকশালবাড়ি কৃষি বিভাগও তার প্রচেষ্টায় উত্সাহী। তন্ময় বলেন, “স্ট্রবেরি চাষ অত্যন্ত লাভজনক। বড় জায়গা নিয়ে চাষ করতে জমি খুঁজছি।” শিলিগুড়ি-নকশালবাড়ি সহ কৃষি অধি কর্তা পাপিয়া ভট্টাচার্য, ফাঁসিদেওয়া-খড়িবাড়ির সহ কৃষি আধিকর্তা মেহফুজ আহমেদরা জানান, পরীক্ষামূলক চাষে ভাল ফল মেলায় চাষিরা দারুণ ভাবে উত্সাহী। আগামী অগস্ট থেকেই চাষ শুরু করতে তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।