শেষ ফোন করেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়েকে

বুধবার রাত সাড়ে ১১টায় বাবার সঙ্গে কথা হয় টুম্পার। ফোন রাখার সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়েকে মন দিয়ে পড়াশোনা করার কথা বলেছিলেন কোচবিহারের নীলকুঠি রেলঘুমটির বাসিন্দা খোকন দে।

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ

কোচবিহার শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:১৯
Share:

ডাকাতদলের গুলিতে নিহত খোকন দে-র শোকার্ত পরিজনেরা। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

বুধবার রাত সাড়ে ১১টায় বাবার সঙ্গে কথা হয় টুম্পার। ফোন রাখার সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়েকে মন দিয়ে পড়াশোনা করার কথা বলেছিলেন কোচবিহারের নীলকুঠি রেলঘুমটির বাসিন্দা খোকন দে। বুধবার রাত আড়াইটে নাগাদ টুম্পার মোবাইলেই ফের ফোন আসে। অন্য প্রান্তের কথা শুনে এ বার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় টুম্পার।

Advertisement

সেই ফোনেই খবর আগে ডাকাতদলের হামলায় মারা গিয়েছেন খোকনবাবু। মেয়ের পরীক্ষা শুরুর আগের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি বাস নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন অসমে। বছর চুয়াল্লিশের খোকনবাবু অসম রুটে চলাচল করা বাসে কন্ডাক্টরের কাজ করেন। কোচবিহার ফেরার পথে অসমের কোকরাঝাড়ে ডাকাত দল হামলা চালায় তাঁদের বাসে। ডাকাতদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু হয় খোকনবাবুর। সেই খবর আসতেই শোকের ছায়া নেমে আসে এলাকাতেও।

এই বাসটিতেই হামলা হয় কোকরাঝাড়ে।

Advertisement

শান্ত স্বভাবের কারণে এলাকায় খোকনবাবুর পরিচিতি ছিল। পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বাসে কন্ডাক্টরের কাজ করছেন। এ দিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এলাকার বাসকর্মীরাও বাড়িতে ভিড় করেছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়ে ছাড়াও তাঁর এক ছেলে রয়েছে। খোকনবাবুর ছেলে সৌরভ এ বারে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। স্ত্রী মিমিদেবী খবর পাওয়ার পরেই কয়েকবার সংজ্ঞা হারিয়েছেন। এ দিন দুপুরে খোকনবাবুর দেহ এসে পৌঁছয় কোচবিহারে। সে সময়ে বাড়িতে ভিড় করে আসেন প্রতিবেশীরাও। পড়শি নিত্য দে বলেন, “বড় শান্ত স্বভাবের ছিল খোকন। বেশি কথাও বলত না। এমন একজন নির্বিবাদী লোককে দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হতে হল, মেনে নেওয়া শক্ত।”

অসম রাজ্য পরিবহণ নিগমের অধীনে লিজে বাস চালানোর বরাত দেওয়া হয়। কোচবিহারের বাসিন্দা সুদীপ সাহার এমন ১৭টি বাস লিজে নেওয়া রয়েছে। তাঁর বাসেই কাজ করতেন খোনকনবাবু। অসমের নওগাঁ থেকে কোচবিহার রুটের বাসে খোকনবাবু কন্ডাক্টর ছিলেন। কোচবিহার থেকে অসম গিয়ে ফিরে আসতে তিন দিন লাগে। মঙ্গলবার তিনি অসমে রওনা দিয়েছিলেন। এ দিনই তাঁর ফিরে আসার কথা ছিল। সুদীপবাবুর কথায়, “ওই রুটের গাড়িতে ডাকাতির ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু কোনওবারই খুনের ঘটনা ঘটেনি। আমরা সবময়ই কর্মীদের বলি ডাকাত দলের সঙ্গে কোনরকম সংঘাতে না যেতে। আর খোকনবাবুও খুব শান্ত স্বভাবের। ওঁকে এ ভাবে মরতে হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশকে কড়া পদক্ষেপ করতে হবে।”

যে বাসে খোকনবাবু ছিলেন তার চালক ছিলেন সুজন বিশ্বকর্মা এবং খালাসি সঞ্জু দাস এখনও আতঙ্কগ্রস্ত। এ দিন তাঁরাও কোচবিহারে ফিরেছেন। তাঁরা জানান, একসঙ্গে তিনটি বাস ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কোচবিহারে ফিরছিল। কোকরাঝাড়ের নিউ পানবাগান এলাকায় দেখেন বোল্ডার, কাঠ ফেলে রাস্তা বন্ধ। বাধ্য হয়ে বাসগুলি পরপর দাঁড়িয়ে পড়ে। সুজনবাবুর কথায়, “হঠাত্‌ই মুখে কালো কাপড় বেঁধে একদল দুষ্কৃতী সামনে চলে আসে। প্রথম বাসটির দু’টি দরজাই বন্ধ ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। চালকের পাশে থাকা দরজায় গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে খুলে দিতে বলে এক দুষ্কৃতী। খোকন-দা তখন ঘুমোচ্ছিলেন।” দুষ্কৃতীদল বাসে উঠেই খোকনবাবুকে আক্রমণ করে বলে জানা গিয়েছে। বাসের খালাসি সঞ্জুবাবু বলেন, “দুষ্কৃতীদলটি কোনও কথা শুনতে চায়নি।” প্রায় আধঘণ্টা ধরে বাসের যাত্রীদের থেকে টাকা, গয়না, মোবাইল লুঠ করে দুষ্কৃতীদলটি।

ঘটনার পরে নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন কোচবিহারের অসমগামী বাস চালক-কর্মীরাও। খোকনবাবুর মেয়ে টুম্পা বলেন, “ওই এলাকায় নাকি মাঝে মধ্যেই ডাকাতি হত। তবে প্রশাসন কেন এতদিন ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসন সর্তক থাকলে আমার বাবাকে এ ভাবে অন্তত ফিরতে হতো না। দুষ্কৃতীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন