হোটেলে অগ্নি-সুরক্ষা নামমাত্র, অভিযানও শুরু হয়নি এখনও

কোথাও ঢোকা বের হওয়ার একটি মাত্রই গেট। কোথাও বা বেসমেন্টে প্রয়োজনীয় জলাধার নেই। অনেক জায়গায় একটি মাত্র সিঁড়ি থাকলেও তা অপরিসর। নিচের পার্কিং বা খোলা এলাকায় গড়ে তোলা রয়েছে রেঁস্তোরা বা পানশালা। আবার পাম্প, হোস পাইপ, যন্ত্রাংশ এবং অ্যার্লাম থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:২২
Share:

সেই হোটেলে ব্যবহারই করা হয়নি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র।—নিজস্ব চিত্র।

কোথাও ঢোকা বের হওয়ার একটি মাত্রই গেট। কোথাও বা বেসমেন্টে প্রয়োজনীয় জলাধার নেই। অনেক জায়গায় একটি মাত্র সিঁড়ি থাকলেও তা অপরিসর। নিচের পার্কিং বা খোলা এলাকায় গড়ে তোলা রয়েছে রেঁস্তোরা বা পানশালা। আবার পাম্প, হোস পাইপ, যন্ত্রাংশ এবং অ্যার্লাম থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে না। সবচেড়ে বড় ব্যাপার বহু ক্ষেত্রেই কর্মীদের অগ্নিনির্বাপক প্রশিক্ষণই নেই। অথচ খাতায় কলমে বছরের পর চলছে ‘মকড্রিল’ও। তার পরেও পুলিশ-প্রশাসন এবং দমকলের সরকারি ছাড়পত্র নিয়ে শিলিগুড়ির অধিকাংশ হোটেলগুলি দিব্যি চলছে বলে অভিযোগ। শুক্রবারও শহরে হোটেলের পরিকাঠামো খতিয়ে দেখতে শুরুই হল না কোনও অভিযান।

Advertisement

এদিনও অবশ্য হোটেলগুলির পরিকাঠামো খতিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ‘আশ্বাস’ দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। মন্ত্রীর কথায়, “আগামী সপ্তাহের শুরুতেই পুলিশ-প্রশাসন, দমকল এবং হোটেল মালিকদের নিয়ে বৈঠক ডাকছি। সেখানে সরকারি আইন মেনে ব্যবসা করার কথা আবার হোটেল মালিকদের জানিয়ে দেওয়া হবে। আবাসিক বা পর্যটকদের জীবনের ঝুঁকি মেনে নেওয়া হবে না।”

গত মঙ্গলবার গভীর রাতে শহরের প্রধাননগরের হোটেলে বিধ্বংসী আগুনে দুই জনের মৃত্যুর ঘটনার পর একে একে পরিকাঠামোর খামতির প্রকট হচ্ছে। ঘটনার তিনদিন পরেও পুলিশ-প্রশাসনের ‘গা ছাড়া’ মনোভাবের জন্য হোটেলগুলির বিরুদ্ধে কার্যত কোনও অভিযান শুরুই হয়নি বলে অভিযোগ। দমকলের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, হোটেলগুলিকে নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। দুই সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তার পরে সরেজমিনে দেখে গোলমাল পেলেই পুলিশে অভিযোগ করা হবে। পুলিশের তরফেও বিভিন্ন হোটেলের কাগজপত্র পরীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

Advertisement

শিলিগুড়ি পুর কর্তৃপক্ষ হাত গুটিয়ে বসে থাকায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। আগামী ১৫ জানুয়ারির আগে অভিযান বা প্রক্রিয়া তাঁরা শুরুই করতে পারবেন না জানিয়েও দিয়েছেন। শিলিগুড়ি পুর কমিশনার সোনাম ওয়াংদি ভুটিয়া জানান, আমরা একটি দল তৈরি করছি। ঘুরে ঘুরে দলটি হোটেলগুলিতে যাবে। কাগজপত্র, পরিকাঠামো পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেব। আমাদের লোকবল কম রয়েছে, তাই দলটি তৈরি করতে সময় লাগছে। ১৫ জানুয়ারি নাগাদ অভিযান শুরু হবে। আর শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার জগমোহন বলেন, “আমরা হোটেলগুলির কাগজপত্র, লাইসেন্স পরীক্ষার কাজ শুরু করেছি। তা দেখে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” ততদিনে পরিকাঠামোর ফাঁকফোকর অনেকটা ভরাট করার সুযোগ মিলবে বলে মনে করছেন হোটেল কর্মীদের অনেকেই।

পুলিশ সূত্রের খবর, প্রধাননগরের যে হোটেলটিতে আগুন লেগে দুই জনের মৃত্যু হয়, সেখানেও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কিছু থাকলেও রাতে কোনও প্রশিক্ষিত কর্মী ছিল না বলে অভিযোগ। সেই সঙ্গে সিঁড়ি, গেট, জলাধারের মত একাধিক ক্ষেত্রে গাফিলতির ঘটনা সামনে আসে। যার জেরে দমকলের করা অভিযোগের ভিত্তিতে হোটেল মালিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। এমনকি, বেসমেন্টে কোনও পার্কিং না থাকলেও সেখানে বহালতবিয়তে রেঁস্তোরা এবং পানশানা করা হয়েছিল।

দমকল সূত্রের খবর, প্রতি তিন মাস অন্তর হোটেলগুলির অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ঠিকঠাক রয়েছে কি না তা দেখার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে মকড্রিল করার নিয়ম রয়েছে। বছর শেষে লাইসেন্স নবীকরণের সময় হোটেল কর্তৃপক্ষকে একটি ‘সেল্ফ ডিক্লারেশন’ দিতে হয়। সেখানে নিয়মিত মকড্রিল হয়েছে কি না বলতে হয়। বাহিনীর অফিসারদের বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রে হোটেলে আগুন নেভানোর পরিকাঠামো রাখা হলেও কর্মী বা মকড্রিল হয় না। ডিক্লেয়ারেশনে তা হয়েছে বলে লিখে দেওয়া হয়। এবার সেই হলফনামা নিয়েই পরীক্ষার কাজ শুরু হবে। দমকলের শিলিগুড়ির ডিভিশনাল অফিসার সনৎকুমার মণ্ডল বলেন, “আমরা হোটেলগুলির পরীক্ষার কাজে হাত দিয়েছি। নিয়ম মেনে ওঁদের নোটিশ পাঠানো হবে। সেখানে লেখা উত্তরে গাফিলতি পেলেই মামলা হবে।”

প্রশাসনিক সূত্রের খবর, শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেট এলাকায় ২৪০টির মত ছোটবড় হোটেল রয়েছে। এরমধ্যে ১০০টি হোটেলের পরিকাঠামো মোটামুটি ঠিকঠাক থাকলেও বাকিগুলি নিয়ে অভিযোগ সামনে এসেছে। পুরসভার থেকে ট্রেড লাইসেন্স, পুলিশের থেকে সরাই লাইসেন্স এবং দমকলের থেকে হোটেলগুলি অগ্নিনির্বাপক লাইসেন্স মূলত পেয়ে থাকে। প্রতি ক্ষেত্রেই ভবনের নকশা ছাড়া একটি লাইসেন্সের পরিপূরক হিসাবে আরেকটির অনুমতি দেওয়া হয়। সেখানে শিলিগুড়ির অধিকাংশ হোটেলই দীর্ঘদিনের পুরানো ভবনে থাকায় সরকারি আইনবিধি পুরোপুরি মানা সম্ভব হয় না বলে হোটেল মালিকদের একাংশের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছে। প্রশিক্ষিত কর্মী রাখা বা মকড্রিল নিয়ে উদাসীনতার কথা অবশ্য অনেক হোটেল মালিকই মেনে নিয়েছেন।

তাঁরা জানিয়েছেন, শহরের বেশির ভাগ হোটেলই পুরানো ভবনে রয়েছে। সেগুলির আমূল সংস্কার, নতুন সিঁড়ি বা জলাধার তৈরির জায়গা নেই। সেখানে যতটা সম্ভব আইন মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ছাদ থেকে পাশের ভবনে যাওয়ার ব্যবস্থাও অনেক হোটেলে করা হয়েছে। তেমনিই ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা বলে নিচে জলাধার তৈরিতেও সমস্যা হয়। গ্রেটার শিলিগুড়ি হোটেলিয়ার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক উজ্জ্বল ঘোষ বলেন, “অভিযোগ যখন উঠেছে, তাই সদস্যদের গুরুত্ব দিয়ে দেখার নির্দেশ দেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন