হোম স্টে নিয়ে কেউ অভিভূত, অনেকে ক্ষুব্ধ, দাবি নজরদারির

গত গ্রীষ্মের ছুটিতে গোটা পরিবার নিয়ে কালিম্পঙের তাকদা গিয়েছিল শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার সরকার পরিবার। ছিলেন তাকদার একটি হোম স্টেতে। সোনপুর মহারাজার প্রাচীন বাংলোটিকে মালিক সুন্দর ভাবে সংস্কার করে চালানো হচ্ছে দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তাঁরা।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:৪৭
Share:

চটকপুরের হোমস্টে।—নিজস্ব চিত্র।

গত গ্রীষ্মের ছুটিতে গোটা পরিবার নিয়ে কালিম্পঙের তাকদা গিয়েছিল শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার সরকার পরিবার। ছিলেন তাকদার একটি হোম স্টেতে। সোনপুর মহারাজার প্রাচীন বাংলোটিকে মালিক সুন্দর ভাবে সংস্কার করে চালানো হচ্ছে দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তাঁরা। আবার, মালদহ থেকে পুজোর ছুটিতে লামাহাটার একটি হোম স্টেতে গিয়েছিলেন প্রণব চক্রবর্তী। কিন্তু সেখানে তাঁর অভিজ্ঞতা অন্য রকমের। একে তো গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে। খেতে হয়েছে বাড়ির সামনের রাস্তার ধারের রেস্তোরাঁয়। এই অভিজ্ঞতায় তাঁর হোমস্টে সম্পর্কে ধারণাই বদলে দিয়েছে।

Advertisement

কোথাও প্রচারের অভাব, কোথাও পরিকাঠামোগত সমস্যা—এই ভাবেই উত্তরবঙ্গের পাহাড় থেকে সমতল বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় সাড়ে ৩৫০টি হোম স্টে চলছে। সঙ্গে আরও নতুন নতুন গজিয়েও উঠছে। পাহাড়, জঙ্গলের গা ঘেঁষা হোমস্টেগুলিতে গিয়ে অনেক সময়ই দুর্ভোগে পড়ছেন পযর্টকেরা।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় পযর্টন মন্ত্রক। সম্প্রতি শিলিগুড়িতে একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন পর্যটন মন্ত্রকের আঞ্চলিক অধিকর্তা (পূর্ব) জেপি শ। তাঁর কথায়, ‘‘হোম স্টে’র মাধ্যমে একটা এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হতে পারে। কিন্তু তা কিছু নিয়ম মেনে করতে হবে। তা ঠিকঠাক হচ্ছে না বলে খবর পাচ্ছি। রাজ্য পর্যটন দফতরের কর্তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। খুব দ্রুত শিলিগুড়িতে একটি সেমিনার, ওয়ার্কশপও করা হবে।’’ তিনি জানান, পর্যটন রাজ্যের বিষয়। কেন্দ্র সাহায্য করে থাকে। তিনি বলেন, ‘‘হোম স্টের ক্ষেত্রে উৎসাহীদের নিয়ম মেনে তা করতে হবে, তার প্রচার এবং নজরদারি দরকার। যে যার মতো বাড়ি, ঘর ভাড়া নিয়ে হোম স্টে চালু করে দিচ্ছেন—এটা হতে পারে না।’’

Advertisement

রাজ্য পযর্টন দফতরের উত্তরবঙ্গের যুগ্ম অধিকর্তা সুনীল অগ্রবাল বলেছেন, ‘‘এক সময় উৎসাহীদের বিভিন্ন সংগঠনকে দিয়ে প্রশিক্ষিণ দেওয়া হয়েছে। এ বার মন্ত্রকের অধীনে গাজিয়াবাদের ইনস্টিটিউট আইআইটিএমকে দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। মন্ত্রকের অফিসারদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওঁরা সেমিনার করতে চাইলে আমরা সব রকম সাহায্য করব বলেছি।’’

নিয়মাবলি একনজরে

• মালিককে পরিবার নিয়ে থাকতে হবে।

• মালিকের নিজের মালিকানাধীন বাড়ি হতে হবে।

• আলাদা ঘর দিতে হবে পর্যটকদের।

• ঘরের সংখ্যা কোনও ভাবেই ৬টির বেশি নয়।

• মোট এলাকা ১৫০/২০০ স্কোয়ার ফুটের মধ্যে।

• কম করে ৪ জন কর্মী থাকতে হবে। তার মধ্যে

এক জন মালিক।

• ন্যূনতম এক জন কর্মীর প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি।

• কিচেন গার্ডেন-সহ খাবারে স্থানীয় রান্নার পদ রাখা দরকার।

সরকারি সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের ‘রুরাল টুরিজম’ নামে আলাদা প্রকল্পই রয়েছে। মন্ত্রকের ‘হুনর সে রোজগার’ প্রকল্পের অধীনেও একে ধরা হয়। তাতে কী ভাবে হোম স্টে করতে হবে বা চালাতে হবে তার সম্পর্কে গাইডলাইন রয়েছে। সরকারি ভাষায় ‘বিএনবি’ বা ‘বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’ বলা হচ্ছে। মালিককে নিজে থেকে হোম স্টে চালানো, নির্দিষ্ট ঘরের সংখ্যা, প্রশিক্ষণ, রেজিস্ট্রেশন কী ভাবে করতে হবে সবই তাতে বলা হয়েছে। বছর খানেক আগে উত্তরবঙ্গ হোম স্টে গিয়ে কাজ শুরু করেছিল রাজ্য পর্যটন দফতর। ২০১৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পাহাড়ের পেদং এবং দার্জিলিং, ডুয়ার্সের পেদং এবং দার্জিলিঙে দু’দিনের কর্মশালা করা হয়েছিল। সেখানে উৎসাহীদের নিয়মাবলি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হাতে গোনা কিছু হোম স্টে কতৃর্পক্ষ রেজিস্ট্রেশনও করান। সরকারি ওয়েবসাইটে এক দফায় তার তালিকাও দেওয়া হয়। ব্যস ওই অবধিই, তার পরে আর কিছু হয়নি বলে অভিযোগ।

পর্যটন মন্ত্রকের একাংশ কর্তারা জানান, পাহাড়ে বা জঙ্গলের গা ঘেঁষা বনবস্তিতে ঘর, ফাঁকা বাড়ি থাকলে অনেকেই হোম স্টের বোর্ড ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। আবার অনলাইনে বা ওয়েবসাইটে ব্যবসাও হচ্ছে। যাতে আসল হোম স্টের স্বাদ বা ধারণা পযর্টকেরা পাচ্ছেন না। কোথাও পাহাড়ে শেল রুটির সঙ্গে লাল আলুর দম, রাই শাক বা মোমো খাওয়ানো হলেও ঘর, শৌচালয়, বিছানা ঠিক নেই। কর্মীদের প্রশিক্ষণ নেই। আবার, ঠিকঠাক গ্রামীণ পরিবেশের কাঠের ঘরে থাকলেও এলসিডি টিভি বা বথুয়া শাক, বোরলি মাছের বদলে রুটি দিয়ে চিলি চিকেন খেতে দেওয়া হচ্ছে। হোম স্টেতে পাহাড় বা ডুয়ার্সের গ্রাম্য পরিবেশে, থাকা, খাওয়ার স্বাদ, সংস্কৃতি জড়িত থাকতে হবে। আবার অনেক জায়গায় খুব সুন্দর করা হলে তার বাণিজ্যিকীকরণ বা প্রচার নেই।

উত্তরবঙ্গের পাহাড়, সমতলের লিনসে, পেদং, রিসি, লামাহাটা, তাকদা, চিমনি, সিটং, চটক, লাটপাঞ্চার, বক্সা, রায়মাটাং, ২৮ মাইল, রাজাভাতখাওয়া, টোটপাড়া, বীরপাড়া, শালকুমার, সাংসিং, কুমলাই, সিলারিগাঁও বা বড় মাঙওয়া’র মতো ঠিকঠাক হোম স্টে চললেও আরও প্রচার, নজরদারি, প্রশিক্ষণ জরুরি বলে মনে করছেন মন্ত্রকের কর্তারা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement