বোঝা: এই ছবি বদলাবে কবে। নিজস্ব চিত্র
বছর কয়েক আগে শিরদাঁড়ার সমস্যায় ভুগছিল শ্রীরামপুরের এক কিশোরী। এলাকার একটি নামী স্কুলের পড়ুয়া মেয়েটির বাবা-মা স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁদের ক্লাসঘর পর্যন্ত যেতে দিতে। যাতে মেয়ের ব্যাগটি তাঁরা বয়ে দিয়ে আসতে পারেন। রাজি হননি স্কুল কর্তৃপক্ষ। বাধ্য হয়ে সে স্কুল ছাড়িয়ে মেয়েকে অন্য স্কুলে ভর্তি করেছিলেন ওই দম্পতি।
স্কুল ব্যাগের সমস্যা আজকের নয়। যারা ছোটবেলায় সুমনের গানে নিজেদের কথা খুঁজে পেত, মনে হত ‘এও কি একটা শাস্তি নয়!’— আজ তারা পরিণত। তাঁদের কারও সন্তান আজ বইছে ‘ভারী’ স্কুলের ব্যাগটা। ভার বেড়েছে আরও কয়েক গুণ। সঙ্গে রয়েছে প্রাইভেট টিউশন।
আর পাঁচটা জায়গার মতো হুগলি জেলাতেও পরিস্থিতি একই। এই ‘যন্ত্রণা’ থেকে খুদে পড়ুয়াদের বাঁচাতে ব্যাগের ওজন বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি এ বিষয়ে নির্দেশিকা জারি হয়েছে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের অনেকেই কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের দাবি, নির্দেশিকা বাস্তবায়িত করতে হলে বদল দরকার পাঠ্যক্রমেও।
স্কুল শিক্ষকদের অনেকেই দাবি করেছেন, স্কুলের কাজ অনুযায়ী, সিলেবাস মেনে ক্লাস নিতে গেলে বাচ্চাদের অনেক রকমের বই আনতে হয়। তাঁদের অভিযোগ, শুধু যে স্কুলের বই নিয়েই পড়ুয়ারা আসে তা তো নয়। স্কুলের পর তাদের টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় টিউশনে। সেখানকার অতিরিক্ত বই-খাতাও বয়ে আনে বাচ্চারা। ফলে বোঝা তো বাড়বেই।
শ্রীরামপুরের মাহেশ পরমেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিঠু মৈত্র বলেন, ‘‘কারও সমস্যা থাকলে তাকে স্কুলের তরফে সাহায্য করা যেতে পারে। কিন্তু সকলের ওজন কমাব কী করে?’’
উত্তরপাড়ার একটি নামী কো-এড স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার মতে, ‘‘নির্দিষ্ট ওজন নিয়ে চলবে কী করে? তবে তো পাঠ্যক্রম ছোট করতে হয়!’’ রিষড়ার বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সিলেবাস অনুযায়ী নির্দিষ্ট বইখাতা আনতেই হয়। স্কুলে বইখাতা রেখে দিলে কী পড়া হচ্ছে তা বুঝতে পারবেন না অভিভাবকেরা!’’
শ্রীরামপুরের শশীভূষণ ঘোষ থার্ড বাই লেনের বাসিন্দা সঞ্চিতা দাসের ছেলে অভ্রনীল একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। সঞ্চিতাদেবীর কথায়, ‘‘ছেলের পিঠে ব্যাগের বোঝা বেশি। কিন্তু কী করব! সরকার নির্দেশ দিলেই তো হবে না। বিকল্পও তো বাতলে দিতে হবে।’’
আরামবাগের সাংসদ অপরূপা পোদ্দারের ছেলে মহম্মদ কবির আলি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে আফসা আলি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্রী। অপরূপা মনে করেন, বাচ্চা শরীরচর্চা ঠিক মতো হলে সমস্যা অনেকটা কমতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘খেলা এখনকার বাচ্চারা জানেই না। সবাই মোবাইলে ডুবে। এতে শারীরিক সক্ষমতাও কমছে। মাধ্যমিক স্তরে স্কুলে ‘স্মার্ট ক্লাস’ চালু হলে বোঝা কমতে পারে।’’
শ্রীরামপুরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক জয়জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, ছেলেমেয়েদের প্রতি বাবা-মায়েদের উচ্চাশাও ব্যাগের ওজন বৃদ্ধির কারণ। বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য একই বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়াতে হয়। স্কুলেও তা নিয়ে আসতে হয়।
চিকিৎসকেরা বলছেন, স্কুলব্যাগের ওজন কমানো জরুরি। পিঠে অতিরিক্ত ভার চাপলে হাঁটাচলার স্বাভাবিক ভঙ্গি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পিঠের ভারের সঙ্গে পেশি, হাড়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। তাতে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হতে পারে। চিকিৎসক ত্রিদীপ মুস্তাফি বলেন, ‘‘ভারী ব্যাগে শিড়দাঁড়ায় চাপ পড়ে। হাড়ের মাঝে থাকা চাকতির মতো অংশ ধীরে ধীরে বসে যায়। তাতে বাড়বৃদ্ধি ব্যহত হতে পারে।’’
হুগলি জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (প্রাথমিক) গোপাল বিশ্বাস বলেন, ‘‘কেন্দ্রের নির্দেশিকা পাইনি। সরকারি স্কুলে ব্যাগের বোঝা খুব একটা থাকে না। নির্দেশিকা এলে দেখা হবে।’’ জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) সুব্রত সেনের দাবি, ‘‘আমাদের রাজ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই স্কুলব্যাগের ওজন বেঁধে দেওয়া আছে।’’
খাতায়-কলমে ওজন ‘বেঁধে’ দেওয়া থাকলেও তা কতটা মানা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।