‘বাংলা সিনেমায় অফার পেয়েছিলাম’

নির্লিপ্ত গলার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘‘আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, কেন?’’বলেছিলাম, ‘‘দেখা হলে বলব।’’গত এপ্রিলের বিধানসভা ভোটে খড়্গপুর তখনও নিশ্চুপ, শান্ত। শুধু বাতাসটাই যা গরম ছিল। চোখ-মুখ ঝলসে যাচ্ছিল সেই হাওয়ায়। সেই গরম হাওয়ায় কান পাতলে শুধু শোনা যাচ্ছিল তাঁরই নাম।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

তখনও বেঁচে। কলকাতায় আনা হচ্ছে আহত শ্রীনুকে। — নিজস্ব চিত্র

নির্লিপ্ত গলার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘‘আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, কেন?’’

Advertisement

বলেছিলাম, ‘‘দেখা হলে বলব।’’

গত এপ্রিলের বিধানসভা ভোটে খড়্গপুর তখনও নিশ্চুপ, শান্ত। শুধু বাতাসটাই যা গরম ছিল। চোখ-মুখ ঝলসে যাচ্ছিল সেই হাওয়ায়। সেই গরম হাওয়ায় কান পাতলে শুধু শোনা যাচ্ছিল তাঁরই নাম। শোনা যাচ্ছিল, এক সময়ে রেল শহর শাসন করা বাসব রামবাবু নাকি এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে। সেই ব্যাটন এখন শ্রীনুর হাতে। অনেক কষ্টে সেই শ্রীনু নায়ডু-র ফোন নম্বরটা জোগাড় করা গিয়েছিল।

Advertisement

সহজ হয়নি দেখা করাটা। ফোনেই জানিয়েছিলেন, গাড়ি নিয়ে অমুক জায়গায় এসে ফোন করুন। নির্দেশ মতো সঙ্গী চিত্র সাংবাদিককে নিয়ে সেই জায়গায় পৌঁছতে পাঁচ মিনিটই লেগেছিল। দ্বিতীয়বার ফোন করতে আবার নতুন নির্দেশ— অমুক জায়গায় এসে ফোন করুন। এ বারের যাত্রা পথে পিছনে একটি বাইক যেন ফলো করছিল মনে হয়েছিল। দ্বিতীয় জায়গায় পৌঁছনোর পরে এক যুবক এসে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি ক্লাবঘরের কাছে।

তফাতে একটি দুধ সাদা বিদেশি গাড়ি দাঁড়িয়ে। সেই গাড়ির কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে পিছনের দরজা খুলে যুবক বসার জন্য ইশারা করলেন। সামনে চালকের আসন থেকে একটি ট্যাটু করা হাত এগিয়ে এল করমর্দনের জন্য, ‘‘আমি শ্রীনু। বলুন কী জানতে চান?’’

এর জন্য মন প্রস্তুত ছিল না। সাধারণ ভাবে ‘ডন’ বলতে যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে তরতাজা এই যুবকের মিল কোথায়? তীক্ষ্ণ দু’টি চোখে সরলতার ছাপ। মুখে একটি মিষ্টি হাসি। এক মাথা কালো চুলের মধ্যে বাদামি রঙের ছোঁয়া। বয়স মেরেকেটে ২৫-২৬।

সে দিন শ্রীনুর সঙ্গে প্রায় ঘণ্টা খানেক কথা হয়েছিল। নানা কথা। বলেছিলেন, কলকাতার বাংলা সিনেমা থেকে অভিনয় করার অফার পেয়েছিলেন, করেননি। কেন? প্রশ্ন শুনে প্রাণখোলা হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘‘দাদা, এ সব আমার কাজ নয়।’’

এ রকম আরও অনেক কথা। দাঁড়িয়ে থাকা অডি গাড়ির এসিটা ফুল স্পিডে চলছিল। সেই গাড়ির আশপাশে বেশ কয়েকজন যুবক বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদেরই একজন কিছুক্ষণ আগে আমাদের ফলো করে এসেছিলেন। তাঁদেরই কেউ কেউ মাঝে মধ্যে বাইরে থেকে জানলায় টোকা দিচ্ছিলেন। কাচ নামিয়ে শুনে নিচ্ছিলেন শ্রীনু। ভোটের টুকিটাকি খবর আসছিল শ্রীনুর কাছে। মাঝে তাঁদেরই একজনকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘মেহেমানকে লিয়ে কুছ ঠান্ডা নেহি লায়োগে কেয়া?’’

আঙুলে পর পর সোনার আংটি, কব্জিতে সোনার বালা, দু’কানে সোনার মাকড়ি, গলায় মোটা সোনার চেন— এত টাকা এল কোথা থেকে? আবার সেই হাসি — ‘‘দাদা, টাকা কামিয়েছি। ঠিক পথে কামিয়েছি। সেই টাকায় এ সব। এই যে গাড়িতে বসে রয়েছেন, এ বছর আমার বৌয়ের জন্মদিনে গাড়িটা তাকে উপহার দিয়েছি।’’

কিন্তু, শোনা যায়, এই সোনার আংটি পরা হাতেই নাকি অনেক রক্তের দাগ? বাসব বামবাবুর পরে রেল শহর শাসন করছে এই তর্জনীই? মিষ্টি হাসির সঙ্গে নিরুত্তাপ গলার উত্তর ছিল, ‘‘কী যে বলেন দাদা! আমাকে দেখে মনে হয় আমি কাউকে খুন করতে পারি?’’ অনেক খোঁচাখুঁচির শেষে শুধু একবারই চোয়ালটা শক্ত হতে দেখেছিলাম, ‘‘বাস, এক বাত বোল সকতা হু। এক দিন অ্যায়সে আয়েঙ্গে, যিস দিন শ্রীনুকে ইশারে কে বিনা ইঁহা-কে পত্তে নেহি হিলেঙ্গে।’’

নাহ! সে দিন আর দেখা হল না। মাঝে দু’তিনবার ফোন করেছিলেন নিজেই, ‘‘কী দাদা, কেমন আছেন?’’ বলেছিলাম, ‘‘কলকাতায় এলে দেখা কোরো।’’ সেই দেখাটাই হল না।

সে দিন চাক্ষুষ করে যেমন বিশ্বাস হয়নি, এই ছেলেটার হাতেই অনেক রক্তের দাগ শুকিয়ে রয়েছে, তেমন আজও বিশ্বাস হচ্ছে না ছেলেটা আর নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন