বাইরে শৌচ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে মেয়েদের

কখনও অভাব। কখনও অভ্যাস। শৌচাগার ব্যবহার না-করার দুটো কারণই মহিলাদের যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ধনেখালির কামালপুরের বধূ। গত শনিবার রাতে শৌচের কাজে বাইরে গিয়ে দুষ্কৃতীর হাতে আক্রান্ত হন তিনি। ধর্ষণের চেষ্টার পর তাঁর মুখে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৭
Share:

‘মাঠে নয়, এ বার বাড়িতেই শৌচাগারে যাব’—বাঁকু়ড়ার গ্রামে শপথবাক্য পাঠ।—ফাইল চিত্র।

কখনও অভাব। কখনও অভ্যাস। শৌচাগার ব্যবহার না-করার দুটো কারণই মহিলাদের যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ধনেখালির কামালপুরের বধূ। গত শনিবার রাতে শৌচের কাজে বাইরে গিয়ে দুষ্কৃতীর হাতে আক্রান্ত হন তিনি। ধর্ষণের চেষ্টার পর তাঁর মুখে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়।

Advertisement

কেন গভীর রাতে একা বাইরে গিয়েছিলেন ওই মহিলা? জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, শৌচাগার তৈরির ক্ষেত্রে হুগলি সারা ভারতে এখন চতুর্থ স্থানে। যথাক্রমে নদিয়া, বর্ধমান, রাজস্থানের বিকানির ও তারপরেই হুগলি রয়েছে সেরার তালিকায়। যদিও হুগলিতে এখনও শৌচাগারহীন ঘর রয়েছে আড়াই লক্ষেরও বেশি। ২০১৪ সালে হুগলিতে শৌচাগার তৈরির লক্ষ্য ছিল ১ লক্ষ ১৫ হাজার। হুগলি জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের কর্মাধক্ষ্য মৌসুমী ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পর জানতে পারি, এখনও ২ লক্ষ ৭৮ হাজার ২৭১টি শৌচাগার হুগলিতে তৈরি করতে হবে। সেই কাজ এখন চলছে। ’’

কিন্তু ওই বধূর পরিবারে খবর নিয়ে জানা গেল, তাঁদের ঘরে শৌচাগার রয়েছে। তা সত্ত্বেও অভ্যাসের বশে রাত প্রায় তিনটে নাগাদ তিনি বাইরে গিয়েছিলেন বলে জানাচ্ছে তার পরিবার। হুগলিতেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে গিয়ে আততায়ীদের হাতে ধর্ষিত হয়ে খুন হন সিঙ্গুরের তাপসী মালিক। উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁর যে দুই কিশোরী বোনকে ২০১৩ সালে ধর্ষণ করে গাছ থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তারাও রাতের অন্ধকারের সুযোগে বাইরে গিয়েছিল বাড়িতে শৌচাগার নেই বলে। এই ঘটনার পর সুলভ শৌচাগারের তরফে ওই গ্রামের সব বাড়িতে শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হয়।

Advertisement

এই সমস্যা অবশ্য কেবল গ্রামের নয়। পুনেতে ২০১২ সালে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পায়, বস্তিবাসী মহিলাদের অন্তত ৩০ শতাংশ শৌচের কাজে বাইরে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। নানা সময়ে উত্তর প্রদেশ, বিহারের মতো রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসনের প্রতিনিধিরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অধিকাংশ ধর্ষণ ঘটে মেয়েদের শৌচকার্যে একা বাইরে যাওয়ার সুযোগে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বচ্ছ ভারত মিশন ঘোষণা করার পর রাজ্যগুলিকে ওই সংক্রান্ত একটি নোট দিয়ে কেন্দ্র জানিয়েছিল, বাড়িতে টয়লেট না থাকায় শৌচকার্যের জন্য রাত অবধি অপেক্ষা করে বাইরে যেতে হয় মেয়েদের, যা তাদের ধর্ষণ ও যৌননির্যাতনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

কিন্তু শৌচাগার গড়ে দেওয়াই এই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান নয়। ধনেখালির বধূর মতোই, গ্রামের বহু পরিবারে দেখা যাচ্ছে, শৌচাগার পাওয়ার পরেও বাইরে যেতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন অনেকে। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, শৌচাগার তৈরি হওয়ার পরেও প্রায় ৬৬ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য বাইরে যাচ্ছেন।

পশ্চিমবঙ্গ ওই সমীক্ষার মধ্যে ছিল না, কিন্তু এখানেও যে ছবিটা খুব আলাদা নয়, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তালিকার শীর্ষে থাকা নদিয়াতেই। নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম জানান, ইতিমধ্যে জেলায় শৌচাগার নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে প্রশাসনের প্রধান চ্যালেঞ্জ তার ব্যবহার নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, ‘‘আমরা জেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার পাড়া কমিটি তৈরি করেছি। কেউ যাতে মাঠেঘাটে শৌচকর্ম না করে সে ব্যাপারে ওই কমিটি, স্কুলের পড়ুয়ারা ও প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নজরদারি চলছে।’’

নদিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি তৃণমূলের বাণী রায় বলেন, ‘‘বহু পরিবারে শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও সেই পরিবারের সদস্যরা পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারছেন না।’’

সম্প্রতি বীরভূমের খয়রাশোলে কাকভোরে পুকুরের ধারে টহলদারি করতে দেখা গিয়েছে জেলা প্রশাসনের কর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের। কেউ বাইরে কাজ সারলেই তাঁরা হাতে কোদাল ধরিয়ে মাটি দিয়ে দুষ্কর্মের নিদর্শন ঢেকে দিতে বলছেন এবং শৌচাগার ব্যবহার করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। বিডিও তারকনাথ চন্দ্র এবং পঞ্চায়েত সভাপতি অসীমা ধীবর জানান, শৌচাগার নির্মাণের লক্ষ্য পূরণ হয়েই যাবে, কিন্তু প্রবণতা বদলানো অত সহজ হচ্ছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন