নজরুল মঞ্চে আশুতোষ কলেজের অনুষ্ঠানে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কেশরীনাথ ত্রিপাঠী ও সৌগত রায়। — নিজস্ব চিত্র।
সরকার যে-হেতু টাকা দেয়, তাই শিক্ষায় তাদের খবরদারির হক ষোলো আনা বলে বরাবর সওয়াল করে আসছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এ বার শিক্ষায়তনে আচরণবিধি বেঁধে দেওয়ার কথা জানিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের বিতর্কে নতুন করে ইন্ধন জোগালেন তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী রবিবার জানিয়ে দেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, সেই ব্যাপারে অচিরেই নির্দেশিকা জারি করতে চলেছে রাজ্য সরকার। শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারী এবং ছাত্রছাত্রীদের সেই নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে।
রাজ্যপাল তথা আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠী গত বছরই জানিয়েছিলেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের জন্য আচরণবিধি চালু করা হবে। কিন্তু শিক্ষা শিবিরের একাংশ সেই বিষয়ে আপত্তি তোলায় উচ্চশিক্ষা দফতর এত দিন বাহ্যত চুপচাপ ছিল। আচরণবিধি সংক্রান্ত নিয়মাবলি তৈরি হয়নি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁদের প্রস্তুতি যে চলছিলই, এ দিন ‘কী করবেন আর কী করবেন না’ জাতীয় নির্দেশিকা জারির কথা জানিয়ে সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন পার্থবাবু।
কী থাকবে আচরণবিধিতে?
শিক্ষামন্ত্রী এ দিন নজরুল মঞ্চে আশুতোষ কলেজের যে-অনুষ্ঠানে আচরণবিধির কথা জানান, সেখানে সবিস্তার ব্যাখ্যার অবকাশ ছিল না। আচার্য-রাজ্যপালের উপস্থিতিতে তিনি শুধু বলেন, ‘‘শিক্ষাঙ্গনে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, তার একটা তালিকা তৈরি করা হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে কলেজগুলিকেও সেই তালিকা মেনে চলতে হবে।’’ উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, যখন-তখন যে-কোনও ছুতোয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘেরাও, ছাত্র সংসদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহিরাগতদের অবাধ দাপাদাপি, বাইরের রাজনীতির অনুপ্রবেশ, ভর্তির সিন্ডিকেট— এ-সবের জন্য পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। রাজ্যের শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে ভুল বার্তা যাচ্ছে। সরকার সেই জন্যই শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য আচরণবিধি তৈরি করে তাঁদের নিয়মে বাঁধতে চাইছে।
শিক্ষা শিবিরের একাংশের মতে, শিক্ষাঙ্গনে সরকারি হস্তক্ষেপের বিতর্ক এই সূত্রেই নতুন ইন্ধন পাচ্ছে। শিক্ষাবিদদের অনেকে আচরণবিধি জারির সরকারি সিদ্ধান্তকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সামিল বলে অভিযোগ তুলছেন। তাঁদের আশঙ্কা, সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে আলোচনা না-করেই সরকারি সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, ‘‘বাইরে থেকে আচরণবিধি চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষাঙ্গনের পরিস্থিতি ঠিক করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে সরকার হস্তক্ষেপ করলে স্বাধিকার ভঙ্গ হয়।’’ প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, নিয়ম অনুযায়ী আচরণবিধি তৈরি করতে হলে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি-র কাছে আবেদন করতে পারে। ‘‘কিন্তু সরকার নিজেরা কোনও আচরণবিধি চাপিয়ে দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্যে আঘাত দেওয়া হয়,’’ বলছেন অমলবাবু।
আচরণবিধি নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনের নেতাদের একাংশও। ওয়েবকুটা-র সদস্য শ্রুতিনাথ প্রহরাজ বলেন, ‘‘বাইরে থেকে আচরণবিধি নির্দিষ্ট করে দেওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত চিন্তায় হস্তক্ষেপের সামিল।’’ শিক্ষক সংগঠন আবুটা-র যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক গৌতম মাইতির অভিমত, ‘‘সরকার আচরণবিধি প্রয়োগ করলে শিক্ষার উন্নতির পরিবর্তে শিক্ষাঙ্গনে হীন দলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে।’’
অশিক্ষক কর্মচারী এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শুভেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এ ভাবে বাইরে থেকে আচরণবিধি চাপিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র ও প্রতিবাদের ভাষায় লাগাম দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’’
আবার এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি মধুজা সেনরায়ের তির্যক পরামর্শ, রাজ্য সরকার আগে তো নৈরাজ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-চত্বরকে মুক্ত করুক! তার পরে না-হয় আচরণবিধির কথা ভাবা যাবে।
আচরণবিধি চালু করার ব্যাপারে প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূলপন্থী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের পাশে পেয়েছেন পার্থবাবু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূলপন্থী শিক্ষাবন্ধু সমিতির ইউনিট সভাপতি মনোজ রায় বলেন, ‘‘চলতি সময়ের প্রেক্ষাপটে সরকার যদি নতুন করে কোনও আচরণবিধি তৈরি করে, তবে তো ভালই। সেটা আরও বিজ্ঞানসম্মত হবে এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ বজা়য় রাখতে সাহায্যই করবে।’’