প্রতিবাদী সুর হয়েই ফের ঝলসে উঠছে দেশপ্রেম

এনআরসি এবং নয়া নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে এ ভাবেই দেশাত্মবোধের বিস্ফোরণ ঘটেছে দেশ জুড়ে।

Advertisement

স্বাতী মল্লিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:১২
Share:

তেরঙা: নয়া আইনের বিরোধিতার আবহে বেড়েছে জাতীয় পতাকা বিক্রি। সোমবার, মতি শীল স্ট্রিটের একটি দোকানে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

দিল্লির যন্তর-মন্তরে রাতভর আন্দোলনে বসেছেন পড়ুয়ারা। সেখানেই বাঁশিতে ‘সারে জঁহা সে অচ্ছা’র সুর তুললেন এক গবেষক ছাত্র। কিছু ক্ষণের মধ্যে সেই সুরে গলা মেলাতে শুরু করলেন বাকিরাও। কলকাতার পথে নাগরিক মিছিলে ‘হম ছিন কে লেঙ্গে আজাদি’ স্লোগানের পাশাপাশি গিটার নিয়ে ‘বেলা চাও’ বা ‘আমরা করব জয়’ গাইতে শোনা গেল তরুণ-তরুণীদের। প্রেম-উৎসবে মেশা ডিসেম্বরের প্রতিবাদী দুপুরে কোরাসে কেউ কেউ আবার গেয়ে উঠলেন ‘পথে এ বার নামো সাথী/পথেই হবে এ পথ চেনা’। বিদেশে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ দেখানোর সময়ে প্রবাসীরা বুকে হাত রেখে গেয়ে উঠলেন জাতীয় সঙ্গীত।

Advertisement

এনআরসি এবং নয়া নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে এ ভাবেই দেশাত্মবোধের বিস্ফোরণ ঘটেছে দেশ জুড়ে। তেরঙা নিয়ে পথে নামা আট থেকে আশির চোখেমুখে এ এক অন্য আবেগ। প্রতিবাদীদের উদ্বুদ্ধ করতে তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে পথে ‘নেমেছেন’ মাস্টারদা সূর্য সেন, ভগত সিংহ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারেরাও। বঙ্গভঙ্গের সময়ে রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধনের স্মৃতি উস্কে দিয়ে চলছে একে অপরকে রাখি পরানোর উৎসব। কেরলের হিন্দু মেয়ের মাথায় উঠছে হিজাব। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো প্রসঙ্গে একদা বিরক্তি দেখানো তরুণ-তরুণীরাও আজ প্রতিবাদের সমর্থনে নিজের ফেসবুকে পোস্ট করছেন ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’। সম্প্রীতির পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখতে ফেসবুকে শয়ে শয়ে শেয়ার হচ্ছে পঞ্চাশের দশকের সিনেমার গান ‘তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনেগা/ইনসান কি অওলাদ হ্যায় ইনসান বনেগা’। অফিসের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বড়দিনের কনসার্টের ভিডিয়োয় ‘বন্দে মাতরম’ শুনে কারও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কেউ বা আবার ফেসবুকে লিখছেন— ‘দেশের এই কঠিন সময়ে এরই বড় প্রয়োজন ছিল।’

তবে কি কঠিন সময়েই দেশের কথা মনে পড়ে আমাদের? কলকাতার নাগরিক মিছিলে যোগ দিতে আসা শান্তিপুরের ধীমান বসাকের মতে, ‘‘দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তবেই তো প্রতিবাদের রাস্তা বেছে নিই আমরা। জাতীয় পতাকা হাতে তুলে নিই। সেই দেশাত্মবোধ কিন্তু কখনও রাষ্ট্রের শাসকের থেকে উৎসারিত হতে পারে না। হয় নিজের ভিতর থেকে। তাই সিনেমা হলে উঠে দাঁড়িয়ে চাপিয়ে দেওয়া দেশপ্রেম প্রমাণে অনেকের আপত্তি ছিল। কিন্তু এখন ভালবাসা থেকেই সেই দেশচেতনা জাগ্রত হচ্ছে।’’

Advertisement

দেশচেতনার ইতিহাস অবশ্য ঔপনিবেশিক সময়ের চেয়ে বেশি পুরনো নয় বলেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা ঋতিকা বিশ্বাস। তাঁর ব্যাখ্যা, চারণকবি মুকুন্দ দাস লোকগানের মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করেছেন। কিন্তু তখন দেশ নিয়ে সেই ভাবে ধারণা ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিযুগে দেশকে মা বলে ভাবা হত। কিন্তু তখনও স্বাধীন ভারত কেমন হবে, সে সম্পর্কে আলাদা আলাদা ধারণা ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। ঋতিকার কথায়, ‘‘দেশচেতনা কিন্তু বহুমাত্রিক। আজ যাঁরা এনআরসি করতে চাইছেন এবং যাঁরা এর বিরোধিতা করছেন, দু’পক্ষের মধ্যে এই দেশচেতনায় ফারাক রয়েছে।’’

ফারাকের কথা মানছেন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন ছাত্র ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির পরিচালক অময় দেবরায়ও। এনআরসি-বিরোধী মিছিলে হাঁটা অময় মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই ‘দেশপ্রেমে’ ভর করেই ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান

সরকার। তাঁর সাফ কথা, ‘‘শেষ লোকসভা ভোট হয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদের উপরে ভিত্তি করে। বেকারত্ব, নোটবন্দির মতো সমস্যাগুলির থেকে নজর ঘুরিয়ে বালাকোট ও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের বলে ম্যাচ জিতেছে সরকার। সে সময়েও কিন্তু জাতীয়তাবাদের একটা জিগির উঠেছিল। তবে এ বার দেশপ্রেমের এই বহিঃপ্রকাশ একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত।’’

লেখিকা বাণী বসুর অবশ্য মত, দেশের কথা ভেবে নয়, স্বার্থে ঘা লেগেছে বলেই আজ দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছে মানুষের মনে। তাঁর যুক্তি, ‘‘আমার পরিচয় নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, রুজি-রোজগার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আমিত্ব আক্রান্ত হচ্ছে বলেই মানুষ দেশকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চাইছে।’’ আর তাই শুধু নিজের অধিকারের দাবিতেই নয়, দেশের জাতপাত-ধর্ম-শ্রেণিবৈষম্য হটাতেও পথে নামুক তরুণ প্রজন্ম— চাইছেন বাণীদেবী। তাঁর কথায়, ‘‘সকলের জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় আদায় করে নিতে হবে আমাদেরই। আর তার জন্য এই আন্দোলন চলতে থাকুক।’’

‘কদম কদম বড়ায়ে যা...’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন