West Bengal Note

গোলাপি রূপে মন ভোলালো দু’হাজারি নোট, মোহ ভঙ্গ বাজারে যেতেই

গোলাপি কাগজটা হাতে নিয়ে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে রীতিমতো বিশ্বজয়ের হাসি হাসলেন শহিদনগর এলাকার বাসিন্দা নির্মল অধিকারী। ভাল করে নেড়েচেড়ে, উল্টে পাল্টে বোঝার চেষ্টা করলেন গোলাপি কাগজটার মাহাত্ম্য। তাঁর আশপাশে ভিড় জমিয়েছেন আরও কয়েক জন ‘বিশ্বজয়ী’।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ১৭:৩৫
Share:

নতুন ২০০০ টাকার নোট হাতে গ্রাহক। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

গোলাপি কাগজটা হাতে নিয়ে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে রীতিমতো বিশ্বজয়ের হাসি হাসলেন শহিদনগর এলাকার বাসিন্দা নির্মল অধিকারী। ভাল করে নেড়েচেড়ে, উল্টে পাল্টে বোঝার চেষ্টা করলেন গোলাপি কাগজটার মাহাত্ম্য। তাঁর আশপাশে ভিড় জমিয়েছেন আরও কয়েক জন ‘বিশ্বজয়ী’। হবে না-ই বা কেন, গোলাপি কাগজটা যে আসলে নতুন দু’হাজার টাকার নোট! যেটা এই প্রথম বারের জন্য ছুঁয়ে দেখছেন সাধারণ মানুষ।

Advertisement

অরূপ সরকার আবার চোখ কুঁচকে কী যেন খুঁজে চলেছেন ওই নতুন নোটের গায়ে। ‘‘জিএসএম-টা কোথায়?’’— প্রশ্ন করে ফেললেন তিনি। বস্তুত, নতুন নোট প্রকাশিত হওয়ার আগেই গুজব রটেছিল, নোটের গায়ে নাকি বৈদ্যুতিন জিএসএম চিপ থাকবে। যার মাধ্যমে কার কোথায় কত লুকোনো নোট থাকছে, তা ধরে ফেলা যাবে সহজে। সেই গুজবের জেরেই নোটের গায়ে চিপ খুঁজছেন অরূপবাবুরা।

কলেজ-পড়ুয়া সৌরীন ধর ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়েই একগাল হেসে বললেন, একশোর নোটগুলো দিয়ে আপাতত হাতখরচ চলে যাবে। দু’হাজারের বড় নোটটার সঙ্গে একটা নিজস্বী তুলে ফেসবুকে পোস্ট করবেন সবার আগে।

Advertisement

আহ্লাদে ডগমগ তরুণী প্রিয়াঙ্কা সরকার জানালেন, কী সুন্দর গোলাপি রং নতুন নোটের! চেহারাটাও অনেকটা ডলারের মতো! ‘‘তবে কাগজটা একটু বোধ হয় পাতলা’’— আঙুল দিয়ে দু’টো টোকা মেরে বললেন প্রিয়াঙ্কা।

নতুন নোটের গোলাপি চেহারায় প্রাথমিক ভাবে মেতেছেন সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটিরাও। স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনও নতুন নোটের ছবি দিয়ে টুইট করে বলেছেন, ‘‘নতুন দু’হাজারি নোট গোলাপি রঙের! ‘দ্য পিঙ্ক এফেক্ট’!’’

নোট-সংশয়ের প্রাথমিক ধাক্কা পার করে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ব্যাঙ্কে-পোস্ট অফিসে লাইন জমিয়েছেন মানুষ। পাঁচশো-হাজারের বাতিল নোটগুলো জমা দেওয়া শুরু হয়েছে। নতুন টাকাও মিলতে শুরু করেছে সকাল থেকে। ভোর থেকে লাইন দিয়ে বাতিল টাকা জমা করে নতুন নোটে হাতে পাচ্ছেন চার হাজার টাকা করে। তবে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কয়েকটি শাখা ছাড়া এই নতুন টাকা দিতে পারেনি প্রায় কেউই। অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেই এখনও নতুন নোট এসে পৌঁছয়নি। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি কয়েক জনকে দিয়েছেন চল্লিশটা করে একশো টাকা। তবে তা চাহিদার তুলনায় কিছুই নয়।

যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে নতুন নোটে চার হাজার টাকা মিলছে, তাতেই থাকছে একটি দু’হাজার টাকার নোট, আর কুড়িটি একশো টাকার নোট। কিন্তু নতুন নোটের প্রাথমিক আনন্দটুকু সামলেই যে প্রশ্নটা গুনগুনিয়ে উঠছে, ‘‘এত বড় নোট নিয়ে করব কী!’’

যেমন বেহালা-সোদপুরের পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়। এলাকার ব্যাঙ্ক থেকে সকাল সকাল চার হাজার টাকা পকেটস্থ করে এক গাল হেসে বাড়ি ফিরেছিলেন এই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। কিন্তু গিন্নির হাতে টাকা তুলে দিতেই সেই হাসি আর রইল না। ‘‘এত বড় নোট দিয়ে এ বার হবেটা কী? কোথায় ভাঙাব টাকা?’’ মাছের দোকান, মুদির দোকান, খবরের কাগজের টাকা, ড্রাইভারের বেতন, জামা-কাপড়ের দোকান, ওষুধের দোকান— কোনও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেই আসবে না এই চকচকে দু’হাজারি নোট।

বাস্তব পরিস্থিতি তো তাই-ই। ছোটখাটো খরচ দু’-এক দিনের জন্য একশোর নোটে চালিয়ে নেওয়া গেলেও, সাতশো-হাজার-বারোশো টাকার খরচগুলোয় হাক-পা বাঁধা পড়বে সাধারণ মানুষের। বিপদে পড়বেন ব্যবসায়ীরাও। ধরা যাক, হাজার টাকার জিনিস কিনলেন কেউ। দশটা একশো টাকার নোট খরচ করা সম্ভব নয় এই পরিস্থিতিতে। হাতে রইল দু’হাজারের নোট। দোকানদারকে সেটা ধরালেই মুখভার তাঁর। কারণ খদ্দেরকে দশটা একশো টাকার নোট ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।

এমনই সমস্যার কথা ভেবে চিন্তিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের গবেষক সায়ন্তনী অধিকারী। বৃহস্পতিবার সকালে পাটুলির বরদা পার্কে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় মাত্র মিনিট পাঁচেকের চেষ্টায় চার হাজার টাকা বদলে ফেলেছেন তিনি। তবে সমস্যা অন্য। সায়ন্তনী বললেন, ‘‘প্রথমে আমায় দু’টি দু’হাজার টাকার নোট দিতে চাইছিলেন ব্যাঙ্ককর্মী। নিতে চাইনি। তার পর মিলল একটা দু’হাজার, বাকি একশোটা কুড়ি টাকার নোট!’’

এই নোট-ভাণ্ডার নিয়ে আতান্তরে পড়েছেন সায়ন্তনী। কুড়ি টাকার নোট দিয়ে তো আর কয়েকশো টাকার জিনিস কেনা যাবে না কয়েকশো টাকার জিনিস কিনে দু’হাজারের নোটও ধরানো যাবে না। সায়ন্তনী বললেন, ‘‘দোকানে গিয়ে একসঙ্গে অনেক জিনিস কিনে বড় বিল করে দু’হাজার টাকা ভাঙানোর চেষ্টা করব। তা ছাড়া উপায় নেই।’’

পূর্ণেন্দুবাবু বা সায়ন্তনীর মতো চিন্তায় মাথায় হাত পড়েছে সাধারণ মানুষের। নতুন নোট পাওয়ার আনন্দ ছাপিয়ে গিয়ে প্রশ্ন উঠছে, ‘‘এ বার কী হবে?’’ তবে চিন্তামুক্ত অনেকেই। টালিগঞ্জের ত্রিদিব ঘোষদস্তিদার যেমন জানালেন, তিনি ব্যবসা করেন। আর সেখানে বড় পরিমাণ টাকার লেনদেন হয় প্রায়ই। তাঁর বরং সুবিধাই হল দু’হাজারি নোট হাতে পেয়ে।

শহিদনগরের নির্মল অধিকারীও বললেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে একটু তো সমস্যা হবেই। কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বড় বিল করতে হবে হয়তো। তবে আরও বেশি একশোর নোট আর নতুন পাঁচশোর নোট চালু হয়ে গেলে আস্তে আস্তে মিটে যাবে সমস্যা।’’

আবার বেহালা বাজারের মাছ-ব্যবসায়ী স্বপন কুণ্ডু বললেন, ‘‘খদ্দেরের কাছেও খুচরো নেই, আমার কাছেও নেই। ব্যবসাটা হবে কী করে? চার-পাঁচশো টাকার মাছ কিনে কী ভাবে টাকা দেবেন তিনি? বড় নোট দিলে আমিই বা কী ভাবে ফেরত দেব?’’

এই সব নোট-প্রশ্ন চোখে নিয়েই আগামী দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন আমজনতা।

আরও পড়ুন: হাজার টাকার নোট শীঘ্রই, আমূল বদলানো হবে ৫০, ১০০ টাকার নোটও

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement