পথ চেনাতে পথেই প্লাবন

কলরবে উত্তাল জনমন

ভিজে একসা ব্যানার। জল ছিটে ধেবড়ে গিয়েও তবু জ্বলজ্বল করছে লালরঙা অক্ষরগুলো। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে লক্ষ্য করে তাতে স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ: এক্সপেক্ট রেজিস্টেন্স! ছাত্রছাত্রীদের মর্যাদা না-দিলে প্রতিরোধ হবেই। শনিবার বিকেলে মিছিলের একেবারে পুরোভাগে এই ঘোষণাই জনজোয়ারের মেজাজটা বুঝিয়ে দিল। আশ্বিনে খেপা শ্রাবণের মতো ঝমঝমে বৃষ্টিও সেই ঝাঁঝ ভোঁতা করতে পারেনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫৬
Share:

ভিজে একসা ব্যানার। জল ছিটে ধেবড়ে গিয়েও তবু জ্বলজ্বল করছে লালরঙা অক্ষরগুলো। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে লক্ষ্য করে তাতে স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ: এক্সপেক্ট রেজিস্টেন্স! ছাত্রছাত্রীদের মর্যাদা না-দিলে প্রতিরোধ হবেই।

Advertisement

শনিবার বিকেলে মিছিলের একেবারে পুরোভাগে এই ঘোষণাই জনজোয়ারের মেজাজটা বুঝিয়ে দিল। আশ্বিনে খেপা শ্রাবণের মতো ঝমঝমে বৃষ্টিও সেই ঝাঁঝ ভোঁতা করতে পারেনি। উপাচার্য ও পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পারদ এ বার খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নিশানা করল।

তবে এ রাগ ঠিক রাজনীতির চেনা বুলির ছকে-বাঁধা রাগ নয়! বরং কোনওরকম দলীয় পতাকার ফাঁদে না-পড়ার শপথই বারবার শোনা গিয়েছে। ফিচেল হাসির মেজাজে হাততালি দিয়ে ছড়া কাটা হয়েছে, ‘এই শতকের দু’টি ভুল / সিপিএম ও তৃণমূল / আলিমুদ্দিন শুকিয়ে কাঠ / শত্রু এখন কালীঘাট!’

Advertisement

বাম জমানায় নন্দীগ্রাম-কাণ্ড বা রিজওয়ানুরের ঘটনার পরে বারবার দলমত নির্বিশেষে রাজনীতির পতাকাহীন মিছিল দেখেছে কলকাতা। পরিবর্তনের পরে গত বছর জুনে কামদুনি-কাণ্ডের ধাক্কায় সংস্কৃতি-জগতের বিশিষ্টজনেদের ডাকেও পথে নেমেছিল এ শহর। সে-বারও সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধতে দেখা যায়। এ বার আরও স্পষ্ট ভাবে শোনা গিয়েছে সেই প্রতিবাদী স্বর। স্লোগান উঠেছে ‘কালীঘাটের হাওয়াই চটি, সাদা শাড়ি, বাংলা থেকে দূর হটো!’

ফেসবুকের সরস টিপ্পনীর ঢঙেও মুখে-মুখে ফিরেছে রঙ্গব্যঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ উপাচার্য তাই হয়ে উঠেছেন ‘কালীঘাটের ময়না’। মিছিল বলেছে, ‘কালীঘাটের ময়না / তোমার দ্বারা হয় না!’ সুকুমার রায়কে স্মরণ করে পুলিশকেও রেয়াত করা হয়নি। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের কাছে কতর্ব্যরত উর্দিধারীদের দেখেই সহাস্য স্লোগান উঠল, ‘পুলিশ দেখে জাপ্টে ধরে / গান শোনাব বিশ্রী সুরে।’

যাদবপুরে পুলিশি অত্যাচারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নেটজগতেই সমকালের একটি জনপ্রিয় বাংলা গানের লাইন ধার করে শুরু হয়েছিল এই প্রতিবাদ। ‘হোককলরব’, শব্দটি তার পর থেকেই আন্দোলনের সহমর্মীদের মন্ত্র হয়ে উঠেছে। নন্দন থেকে রাজভবনের পথেও তাই বারবার রোল, হোক, হোক, হোক, হোককলরব! এবং এই কলরব স্রেফ ছাত্রছাত্রী বা তরুণ সমাজের মধ্যেই আটকে থাকেনি।

৭৫ বছরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী দিলীপ দাস এই ভিড়ের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ‘ফিয়ার নাথিং’ লেখা চুপচুপে ভিজে গেঞ্জির যুবকের পাশেই হাঁটছিলেন তিনি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মহিলার চটি ছিঁড়ে গিয়েছে। সেই চটি হাতে নিয়ে শাড়ি সামলে হাঁটছেন দৃপ্ত ভঙ্গিতে।

গলার শিরা ফুলিয়ে শিখ যুবক স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘ছিন লেঙ্গে আজাদি!’ তাঁর খুব কাছে হাঁটতে থাকা কলেজ-তরুণীর মাথার ফেট্টিতে লেখা ‘বহিরাগত’। সেন্ট জেভির্য়াস কলেজের ছাত্রীটি হাসতে হাসতে বললেন, “যাদবপুরের ঘটনা যখন, তা হলে আমিও তো বহিরাগত!”

সপসপে ভিজে টি-শার্ট, কুর্তি, শর্টসের তরুণদের ফুর্তির শেষ নেই। রোগা চেহারার চশমা-নাকে একটি মেয়েকে দেখে তাঁর সহপাঠীদের ঠাট্টা: কী রে, তুই তো কলেজের ক্লাসের বাইরে কিচ্ছু জানিস না! মেয়েটির চোখা জবাব: যাদবপুরে যা ঘটেছে, তার পরেও কী বসে থাকব!

স্রেফ নেট-প্রচার নির্ভর অসংগঠিত মিছিলের ডাকে ঘরে বসে থাকতে পারেননি অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও। বললেন, “জীবনে এর আগে কখনও এমন সিরিয়াসলি মিছিলে হাঁটতে পথে নামিনি!” স্বস্তিকা যাদবপুরের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তনী।

নাটক-সিনেমার অঞ্জন দত্ত, সুমন মুখোপাধ্যায়, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়রাও এই মিছিলেরই মুখ! ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে পথে নেমেছেন চেনা-অচেনা মাস্টারমশাইরা। যাদবপুরের শিক্ষক ইংরেজির চান্দ্রেয়ী নিয়োগী, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মধুবন্তী মৈত্র বা বাংলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক সৌমিত্র বসু (বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)-ও ঘরে বসে থাকতে পারেননি। যাদবপুরের প্রাক্তনী এক দম্পতি সুপ্রিয়া ও অরূপ চক্রবর্তীও আগাগোড়া হাঁটলেন মিছিলে। সুপ্রিয়া বললেন, “আমার মেয়েও ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। এখন বিকেল পাঁচটা বাজলেই ওর জন্য চিন্তা হয়। আমাদের সময়ে নির্ভয়ে কত রাত পর্যন্ত ক্যাম্পাসে থাকতাম!”

পুলিশ অবশ্য খাতায়-কলমে এই ভিড়কে ছ’হাজারের বেশি বলে মানতে চায়নি। তবে বিকেল চারটেয় মিছিলের মুখ মেয়ো রোডের কাছাকাছি এসে পৌঁছনোর সময়েও দেখা গেল শেষ ভাগ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের কাছে। পুলিশের একাংশই ঠারেঠোরে মানছেন, লালবাজার যা বলছে মিছিলের বহর তার দু’-তিন গুণের কম নয়!

বেলা আড়াইটেয় মিছিলের পথ চলা শুরুর সময়ে বৃষ্টি পড়ছিল মুষলধারে। সেই বৃষ্টিই যেন মিছিলকে আরও খেপিয়ে তুলল। তাৎক্ষণিক স্লোগান উঠল, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, যাদবপুর গেছে খেপে!’ আর এই খ্যাপামির শরিক কলকাতার সঙ্গে গোটা দেশের ছাত্রসমাজ।

মেয়ো রোডের মুখে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে থামাতে হয় মিছিল। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলকে পুলিশ রাজভবনে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যায়। তত ক্ষণ অপেক্ষমান ভিড়কে পথনাটকে মাতিয়ে রাখলেন স্কটিশ চার্চ কলেজ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা।

প্রতিনিধিরা ফিরে এসে সহযোদ্ধাদের জানালেন, তাঁদের রাজভবন অভিযান সফল। রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা খুশি। শুনেই ফের উল্লাস। তখন সন্ধে সাতটা। বৃষ্টি থেমেছে। আন্দোলনকারীদের চুপচুপে ভেজা পোশাক শুকিয়েছে গায়েই। বিদায়বেলায় ফের স্লোগান, ‘পুলিশ যত মারবে / মিছিল তত বাড়বে’। ক্লান্তি ছাপিয়ে লড়াইয়ের উত্তাপ তখন ছড়িয়ে-পড়ছে জনতার চোখেমুখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন