বিজেপি কর্মী খুনের মামলায় সন্দীপ কেন জালে, প্রশ্ন ঘুরছে জেলায়

রাজনীতির সাতে-পাঁচে তাঁকে দেখা যেত না। কিন্তু, বিজেপি কর্মী খুনে জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি তৃণমূলের সৃষ্টিধর মাহাতোর বড় ছেলে সেই সন্দীপ মাহাতোকে সিআইডি গ্রেফতার করায় তাজ্জব অনেকেই।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:২৬
Share:

ধৃত: পুরুলিয়া আদালতে তোলা হচ্ছে সন্দীপকে। ছবি: সুজিত মাহাতো।

রাজনীতির সাতে-পাঁচে তাঁকে দেখা যেত না। কিন্তু, বিজেপি কর্মী খুনে জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি তৃণমূলের সৃষ্টিধর মাহাতোর বড় ছেলে সেই সন্দীপ মাহাতোকে সিআইডি গ্রেফতার করায় তাজ্জব অনেকেই। শনিবার তাঁকে পুরুলিয়ার ভাটবাঁধের ভাড়াবাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করার খবর ছড়িয়ে পড়তেই চর্চা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে।

Advertisement

পঞ্চায়েত ভোটে বলরামপুরে তৃণমূলকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছে বিজেপি। সৃষ্টিধরবাবু নিজে যেমন হেরেছেন, তেমনই তৃণমূলের হাত থেকে সরে গিয়েছে সাতটি পঞ্চায়েত থেকে বলরামপুরের পঞ্চায়েত সমিতিও। এরপরেই ৩০ মে বলরামপুরের সুপুরডি গ্রামের অদূরে খুঁদিগোড়ার জঙ্গলে বিজেপির যুবমোর্চার কর্মী ত্রিলোচন মাহাতোর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। কিছু দিনের ব্যবধানে বলরামপুরেরই ডাভা গ্রামের বাসিন্দা বিজেপি কর্মী দুলাল কুমারের ঝুলন্ত দেহ মেলে বিদ্যুতের হাইটেনশনের খুঁটি থেকে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে বিজেপি কর্মী জগন্নাথ টুডুর অস্বাভাবিক মৃত্যুকে ধরে বিজেপি দাবি করে, তাঁদের তিন কর্মীকে তৃণমূল খুন করেছে। সিবিআই তদন্ত চেয়ে তোলপাড় করে বিজেপি। জেলায় সভা করে যান বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ।

তদন্তের কিছুদিনের মধ্যেই সিআইডি খুনে অভিযুক্ত বলে সুপুরডির বাসিন্দা পাঞ্জাবি মাহাতোকে গ্রেফতার করে। তারপর কয়েক মাস পরে শুক্রবার বলরামপুরের রাঙাডির উত্তম পাল ও শনিবার সুপুরডির আর এক বাসিন্দা জগবন্ধু মাহাতোকে গ্রেফতার করেন। স্থানীয় ভাবে পাঞ্জাবির রাজনৈতিক পরিচিতি তেমন সুস্পষ্ট না হলেও উত্তম ও জগবন্ধু এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত। ১১ জুন গভীর রাতে উত্তমের মোটরবাইক দুষ্কৃীতারা পুড়িয়ে দেওয়ায় বিজেপির দিকে আঙুল তুলেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সেই মামলারও তদন্ত করছে সিআইডি।

Advertisement

ঘটনার ক্রম

• ৩০ মে ২০১৮ বলরামপুরের সুপুরডি গ্রামের প্রান্তে একটি বটগাছে বলরামপুর কলেজের ইতিহাস অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ত্রিলোচন মাহাতোর ঝুলন্ত দেহ মেলে। পরনের টি-সার্টে লেখা ছিল— “বিজেপি করা! এবার বোঝ”।
• আগের রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন ত্রিলোচন। মঙ্গলবার বিকেলে সাইকেল নিয়ে বেরোন। মেজদা শিবনাথ মাহাতো বলেন, ‘‘রাত পৌনে ৯টা নাগাদ ভাই ফোনে বলে, ‘ওরা আমাকে মোটরবাইকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। চোখ বাঁধা। মনে হয় মেরে ফেলবে। আমাকে বাঁচা’। ফোন কেটে যায়।’’
• নিহতের বাবা হাড়িরাম মাহাতো অভিযোগপত্রে জানান, ভোটের দিন গ্রামের কয়েক জনের সঙ্গে তাঁর ছেলের ঝগড়া হয়। তিনি সেই ছ’জনের নামে খুনের অভিযোগ করেন।
• ত্রিলোচন এ বার বিজেপির হয়ে ভোটে কাজ করেন। সুপুরডি সংসদ তো বটেই, স্থানীয় তেঁতলো-সহ সাতটি পঞ্চায়েত দখল করে বিজেপি। বলরামপুর পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের দু’টি আসনও হাতছাড়া হয় তৃণমূলের। পর্যুদস্ত জেলা পরিষদের আগের বারের সভাধিপতি তৃণমূলের সৃষ্টিধর মাহাতো।
• ত্রিলোচনের দেহ উদ্ধারের পরে সৃষ্টিধর বলেছিলেন, ‘‘ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক। প্রয়োজনে সিআইডি তদন্ত হোক।’’ সিবিআই তদন্তের দাবি করে মৃতের পরিবার ও বিজেপি।
• ২৪ জুন পাঞ্জাবি মাহাতো নামে সুপুরডি গ্রামেরই এক বাসিন্দাকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
• শুক্রবার গ্রেফতার করা হয় উত্তম পাল নামে রাঙাডি গ্রামের যুবককে।
• শনিবার গ্রেফতার হন সৃষ্টিধর মাহাতোর বড় ছেলে সন্দীপ মাহাতো এবং জগবন্ধু মাহাতো নামে এক অভিযুক্তকে।

স্থানীয় তৃণমূল সূত্রের খবর, ভোরে আগে পর্যন্ত সন্দীপের পরিচয় ছিল সভাধিপতির ছেলে। তাঁর ভাই সুদীপ তৃণমূলের ব্লক সভাপতি ও পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। দু’জনেই এলাকায় প্রভাবশালী থাকলেও সন্দীপের আচরণে তা টের পাওয়া যেত না বলেই ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন। সন্দীপকে সে ভাবে তৃণমূলের কর্মসূচিতে দেখা যেত না। কালেভদ্রে তৃণমূলের কোনও বিজয় মিছিলে বড়জোর তাঁকে দেখা গেলেও রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে তিনি বরাবর দূরেই থেকেছেন। সেই সন্দীপের এই রাজনৈতিক খুনে নাম জড়িয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।

সন্দীপ মাহাতো কে?

• পুরুলিয়া জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর বড় ছেলে।
• পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করেন। সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করতেন না।
• খয়রাডিতে বাড়ি হলেও ছেলের প়ড়াশোনার জন্য গত আড়াই মাস ধরে বাড়ি ভাড়া করে থাকছিলেন পুরুলিয়া শহরের ভাটবাঁধে।
• শনিবার সকালে ভাটবাঁধের বাড়ি থেকে ডেকে গ্রেফতার করে সিআইডি।

বলরামপুরের তৃণমূল কর্মীরা বলছেন, ‘‘সন্দীপের সঙ্গে ভোটের যোগাযোগ বলতে বাবা বা ভাইয়ের হয়ে ফাইফরমাস খাটা পর্যন্ত। বলরামপুরে দলের ছোটখাটো সভাতেও তাঁকে কখনও মঞ্চে বসে থাকতেও দেখেননি এলাকার মানুষজন। বাবা-ভাই রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকায় সন্দীপ বরং পৈতৃক ইটের ব্যবসা দেখাশোনাতেই বেশি মন দিয়েছিলেন। সেই সন্দীপকে সিআইডি রাজনৈতিক খুনের মামলায় গ্রেফতার করায় নানা প্রশ্ন ঘুরছে বিভিন্ন মহলে। শাসকদলের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘দল এই তদন্তে যে কোনও ভাবেই হস্তক্ষেপ করছে না, তা এই গ্রেফতারের ঘটনা থেকেই প্রমাণিত।’’ আবার কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বলরামপুরের হার দলকে বেশি ব্যথা দিয়েছে। ওই কেন্দ্রের বিধায়ক স্বয়ং দলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো। তাই দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে বলরামপুরের মানুষের মনে ফিরে পেতে মরিয়া তৃণমূলের নেতারা। ইতিমধ্যেই সৃষ্টিধরের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে দলের জেলা নেতাদের। সুদীপকেও ব্লক সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জগবন্ধু মাহাতো ও উত্তম পাল

সন্দীপকে গ্রেফতার করার খবর বলরামপুরে পৌঁছনোর পরে তাঁর ভাই সুদীপ ও ব্লকের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী পুরুলিয়া শহরে গিয়ে শান্তিরামবাবুর সঙ্গে দেখা করেন। সন্দীপ-সহ একের পর এক এ ভাবে দলের কর্মীদের গ্রেফতারির ঘটনায় তাঁরা অবাক, এমন কথাও বলেন এক নেতা। দল সূত্রের খবর, জেলা সভাপতি তাঁদের কথা শুনেছেন বটে। কিন্তু আশ্বস্ত করতে পারেননি। ধৃত উত্তমের মা ও বাড়ির লোকজনও শান্তিরামবাবুর সঙ্গে দেখা করেন। উত্তম নিরপরাধ বলে দাবি করেছেন তাঁর মা পুতুলদেবী।

বিজেপি বলেছে, ‘‘চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সিআইডি এই মামলার বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টের কাছে সময় নিয়েছে। তারপরে তদন্তের অগ্রগতি হাইকোর্টের কাছে জানাতে হবে। তবে তাঁরা জানাচ্ছেন, এক মাত্র সিবিআই তদন্ত হলেই আরও মাথা ধরা পড়বে। তৃণমূলের বলরামপুর ব্লক সভাপতি অঘোর হেমব্রম বলেছেন, ‘‘উত্তম ও জগবন্ধু আমাদের দলের কর্মী। আমরা আইনের উপরেই ভরসা রাখছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন