হাহাকার: স্বামীহারা বিউটি। শনিবার মধ্যমগ্রামের বাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।
একটা শ্বেতপদ্ম হাতে সেই সকাল থেকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বছর বারোর ছেলেটা। তার পর মাঝ-দুপুরে অমিতাভ মালিকের কফিনবন্দি দেহ যখন মধ্যমগ্রামে ঢুকল, তখন হাজারো জনতার ভিড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে! শেষ পর্যন্ত অবশ্য কফিনের উপরে ফুলটা রাখতে পেরেছিল ও। নিয়ে গিয়েছিলেন পুলিশ অফিসার। ছেলেটা কাঁদছিল। বলছিল, ‘‘দাদাটা আমাদের মধ্যমগ্রাম হাইস্কুলে পড়ত।’’
ছাব্বিশ বছরের শহিদ পুলিশ অফিসারের দেহ ঠিক কখন বাড়িতে আনা হবে, ওই কিশোরের মতো অনেকেই জানতেন না। তবু সকালের আলো ফুটতেই ভিড় জমতে শুরু করে মধ্যমগ্রাম থানা, সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অমিতাভর পাটুলি-শিবতলার বাড়ির সামনে। বেলা যত গড়িয়েছে, ভিড়ের বান ডেকেছে। মধ্যমগ্রাম, বারাসত, এমনকী কলকাতা থেকেও বহু মানুষ এসেছেন। দাঁড়িয়ে থেকেছেন নিঃশব্দে। দখল হয়ে গিয়েছে রাস্তার দু’ধার, মাঠ, গাছ, প্রায় প্রতিটা বাড়ির ছাদ। ভিড় সামলাতে মোতায়েন ছিল ৪০০ পুলিশ। অথচ ভিড়ের কোথাও লেশমাত্র বিশৃঙ্খলা ছিল না। যা দেখে ডিআইজি তন্ময় রায়চৌধুরীকে বলতে শোনা যায়, ‘‘এমন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ পুলিশ-জীবনে কখনও দেখিনি।’’
আরও পড়ুন:বন্ধ-পোস্টার ছিঁড়ে খুলে গেল পাহাড়
শুক্রবার রাতে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছিল অমিতাভের দেহ। শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ দেহ নিয়ে রওনা হন পরিবারের লোকেরা। বাগডোগরা বিমানবন্দরে তাঁকে শেষ বিদায় জানায় দার্জিলিং পুলিশ। তার পর কলকাতা।
মধ্যমগ্রামের বাড়ির সামনে ছবি তুলছিলেন বিধাননগরের পাঁচ কলেজ-পড়ুয়া। তাঁদেরই এক জন, মিতালি বসু বললেন, ‘‘যারা আমাদের রাজ্য ভাগ করতে চাইছে, তাঁদের রুখতে প্রাণ দিয়েছেন এই তরুণ অফিসার। তাই এক বার চোখের দেখা দেখতে এসেছি।’’ চড়া রোদে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে সোদপুরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পীযূষ চৌধুরী বললেন, ‘‘ছেলের মৃত্যুর পরে যাঁর বাবা বলেন, ‘তবুও রাজ্য ভাগ চাই না’, সেই পরিবারকে স্যালুট জানাতে এসেছি।’’ ১০ মাসের ছেলে কোলে ঠায় দাঁড়িয়ে মমতা মণ্ডল। বললেন, ‘‘কী ভাল ছেলে। যেমন পড়াশোনায়, তেমনই ব্যবহার।’’
ছোঁয়াটুকু: নিহত এসআই অমিতাভর কফিন আঁকড়ে মা ও স্ত্রী। শনিবার মধ্যমগ্রামে। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
বাবা সৌমেনবাবু, মা গীতাদেবী, ভাই অরুণাভ, স্ত্রী বিউটি কফিন আঁকড়ে পড়ে। সামলানো যাচ্ছিল না বিউটিকে। দিশাহারা দেখাচ্ছিল মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার থেকে শুরু করে রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ পুরকায়স্থ, এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মার মতো পুলিশকর্তাদের। বাড়ি তৈরির ব্যাঙ্ক-ঋণ ঝুলছে মাথায়। তার কী হবে? পুলিশকর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘এই পরিবারের সব দায়িত্ব আমাদের।’’
এক সময়ে বাড়ির গলি, চেনা পাড়া— সব ছেড়ে সহকর্মীদের কাঁধে শেষ বারের মতো বেরিয়ে আসেন অমিতাভ। বিরাট কনভয় পৌঁছয় নিমতলা শ্মশানে। কফিন জড়িয়ে তখনও বিড়বিড় করছেন বিউটি। মুখাগ্নি করেন ভাই অরুণাভ। সন্ধে নামতেই সব শেষ।
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি ওকে চিনতাম। দার্জিলিঙে দেখা হয়েছিল। সাহসী ছেলে। খুব মর্মান্তিক ঘটনা। গরিব পরিবারের ছেলে। পরিবারের জন্য যা যা করার, করছি।’’ যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ প্রশ্ন তুলেছেন, সশস্ত্র গুরুঙ্গ-বাহিনীর মোকাবিলায় কোবরার মতো প্রশিক্ষিত বাহিনীর বদলে অমিতাভদের কেন পাঠিয়েছিল রাজ্য?
সন্ধেয় অমিতাভকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী—
‘নিভে গেল দিয়া
নিস্তব্ধ হল প্রাণ
পরিণত হল জীবন
এক মর্মান্তিক কফিনে...।’
সহ প্রতিবেদন: শমীক ঘোষ ও সৌমিত্র কুণ্ডু