লাঠিধারী ‘নিধিরাম সর্দার’দের কে ভয় পাবে? প্রশ্ন পুলিশের অন্দরেই

গত তিন দিনে বসিরহাট, বাদুড়িয়ায় গোটা দশেক পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। ভেঙেছে আরও বেশি। হাতে লাঠি আর মাথায় হেলমেট নিয়ে গোলমাল ঠেকাতে গিয়ে মার খেয়েছেন নিচুতলার পুলিশকর্মীরা। হাতে-মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে তার পরেও ডিউটি করছেন তাঁরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৭ ০৩:৫৮
Share:

ক্ষোভের-আঁচ: বসিরহাটে পুড়িয়ে দেওয়া হলো বাইক। নিজস্ব চিত্র।

বাদুড়িয়া থানার এক পুলিশকর্মী আক্ষেপ করছিলেন— শিরদাঁড়ায় আর হাড় নেই, সব সুতো হয়ে গিয়েছে!

Advertisement

কনস্টেবল পদ মর্যাদার ওই পুলিশকর্মী হালকাচ্ছলে কথাটা বললেন বটে, কিন্তু এর মধ্যেই যে তলানিতে ঠেকে যাওয়া মনোবলের দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে ভুল করেননি উঁচুতলার অফিসারেরা। দু’দিন আগে এই বাদুড়িয়া থানার সামনেই পুলিশের তিন-তিনটে গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল উন্মত্ত জনতা। সদর গেটে তালা ঝুলিয়ে থানার ভেতর থেকে সেই দৃশ্য দেখেছিলেন পুলিশকর্মীরা। ভিন্ জেলা থেকে উত্তর ২৪ পরগনার ওই প্রত্যন্ত এলাকায় ডিউটি করতে যাওয়া এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘লালগড়ে মাওবাদী হানার সময় এ ভাবেই দরজায় খিল এঁটে বসে থাকতে হতো। বাইরে বেরোনোর সাহস ছিল না!’’

গত তিন দিনে বসিরহাট, বাদুড়িয়ায় গোটা দশেক পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। ভেঙেছে আরও বেশি। হাতে লাঠি আর মাথায় হেলমেট নিয়ে গোলমাল ঠেকাতে গিয়ে মার খেয়েছেন নিচুতলার পুলিশকর্মীরা। হাতে-মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে তার পরেও ডিউটি করছেন তাঁরা। জনতার মার থেকে রেহাই পাননি এমনকী জেলার পুলিশ সুপার। বুধবারও মার খেয়েছেন বসিরহাটের মহকুমা পুলিশ অফিসার। কিন্তু কেন এই হাল? পুলিশের একাংশ বলছেন, বন্দুককেই ভয় পায় আইনভঙ্গকারীরা। ব্যবহার না-করলেও হাতে অস্ত্র দেখেই তারা পিছু হটে। কিন্তু লাঠিধারী ‘নিধিরাম সর্দার’দের কে ভয় পাবে? ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে—পুলিশ আড়ালে সেঁধিয়েছে, দুষ্কৃতীরা প্রকাশ্যে গর্জেছে। অনেক ক্ষেত্রে চোখের সামনে দোকানপাটে আগুন লাগাতে দেখেও দাঁড়িয়ে থেকেছে বাহিনী।

Advertisement

আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল যুদ্ধং দেহি

সেই ক্ষোভই ধিকিধিকি জ্বলছে। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশ দুষছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘সংঘর্ষ ঠেকাতে আমাদের পাঠানো হচ্ছে। মার খাচ্ছি আমরাই। অস্ত্র চেয়েও পাচ্ছি না। সাহেবরা (নিচুতলার পুলিশ অফিসারদের সাহেব বলে) বলছেন, গুলি চালানো যাবে না। চালাব কেন, ভয় দেখানোর জন্যও তো বন্দুক দিতে পারে।’’ জেলার অফিসারেরা যে বাহিনীর এই মনোভাব বুঝছেন না, তা নয়। কিন্তু বুঝেও তার দায় নিতে নারাজ। তাঁরা দেখাচ্ছেন পুলিশের শীর্ষমহলকে, যাঁরা বুঝিয়ে-সুজিয়ে উন্মত্ত জনতাকে শান্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘সব সময় টোটকায় কাজ হয় না। প্রয়োজনে ইঞ্জেকশন দিতে হয়, এটাই বোঝানো যায়নি উঁচুতলাকে।’’ নবান্ন অবশ্য সংযমেই আস্থা রেখেছিল। এক শীর্ষকর্তার যুক্তি, ‘‘গুলি চালালে একশো-দেড়শো লোক মারা যেত। সেই জন্যই তো পুলিশকে সংযত থাকতে বলা হয়েছিল!’’

বসিরহাট, বাদুড়িয়া নমুনা মাত্র। পাহাড়েও একের পর এক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশের গাড়ি। জনতার তাড়ায় দার্জিলিঙে পুলিশ জুতো খুলে ছুটছে, এমন ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। গত বছর মালদহের কালিয়াচকেও ঘটেছে একই ঘটনা। জনতার আক্রমণে থানা ছেড়ে গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন পুলিশকর্মীরা।

কর্তাদের একাংশ বলছেন, পিছু হটতে হটতে মনোবলে চিড় ধরেছে বাহিনীর। বীরভূম, হাওড়া, নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জ্বলেছে একের পর পুলিশের গাড়ি— তালিকাটা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন