নেতাদের চাপে অধরা দুষ্কৃতীরা, ক্ষোভ পুলিশে

ফোনের ওদিকে পুলিশকর্মীর গলা রীতিমতো অসহায় শোনাল। “আমাদেরই ছেলেকে মারল, আমরা দোষীকে ধরতে পারছি না। একজন নেতার কথায় সব চলছে। সে কিছু না বলা পর্যন্ত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকতে হবে আমাদের।” ক্ষোভ চেপে রাখতে পারছেন না বীরভূমের পুলিশ অফিসাররা। সোমবার রাতে বক্রেশ্বর শ্মশানে শেষ হয় দুবরাজপুর থানার এসআই অমিত চক্রবর্তীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। ডিউটিরত অবস্থায় বোমার আঘাতে মৃত অমিতবাবুর দাহের পর ভোরে বাড়ি ফিরেছেন বেশ কিছু পুলিশ অফিসার।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

দুবরাজপুর ও কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৪ ০২:৩৫
Share:

শ্মশানের পথে এসআই অমিত চক্রবর্তীর দেহ। —ফাইল চিত্র

ফোনের ওদিকে পুলিশকর্মীর গলা রীতিমতো অসহায় শোনাল। “আমাদেরই ছেলেকে মারল, আমরা দোষীকে ধরতে পারছি না। একজন নেতার কথায় সব চলছে। সে কিছু না বলা পর্যন্ত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকতে হবে আমাদের।”

Advertisement

ক্ষোভ চেপে রাখতে পারছেন না বীরভূমের পুলিশ অফিসাররা। সোমবার রাতে বক্রেশ্বর শ্মশানে শেষ হয় দুবরাজপুর থানার এসআই অমিত চক্রবর্তীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। ডিউটিরত অবস্থায় বোমার আঘাতে মৃত অমিতবাবুর দাহের পর ভোরে বাড়ি ফিরেছেন বেশ কিছু পুলিশ অফিসার। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত অমিতবাবুর উপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারেননি তাঁরা।

৩ জুন দুবরাজপুরের ‘টাউনবাবু’ অমিত চক্রবর্তীর উপর হামলার ঘটনা ছাড়াও, ১৯ জুলাই খয়রাশোলে পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর এবং পুলিশকর্মীদের উপর আক্রমণের স্মৃতি এখনও টাটকা। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিল শাসক দলের ২৯জন কর্মী। মাত্র ছ’জনকে ধরা গিয়েছে। অভিযোগের গোড়ায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের পুলিশ ধরতে পারেনি এক্ষেত্রেও। তাই নিয়েও পুলিশ লাইনে অনেককে ক্ষোভ উগরে দিতে শোনা গিয়েছে। তাঁরা বলেন, “পুলিশকেই যদি এ ভাবে মার খেতে হয়, এমনকী মরতেও হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবেন কোথায়?” অমিতবাবু গুরুতর আহত হয়ে যখন চিকিৎসাধীন, তখনও মূল অভিযুক্ত তৃণমূলের নেতা, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য শেখ আলিম নিয়মিত দফতরে আসছিলেন। গত শনিবারও তিনি বিডিও অফিসে যাতায়াত করেছেন। পুলিশেরই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে করা এফআইআর-এ শেখ আলিমের নাম পয়লা নম্বরে। কিন্তু শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতার অনুমতি না মেলায় শেখ আলিমকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। অমিতবাবুর মৃত্যুর খবর আসতেই শেখ আলিম বেপাত্তা হয়ে যান। মঙ্গলবার রাতে পুলিশ তাঁর খোঁজে তল্লাশি চালাতে পারে বলে খবর। পুলিশেরই একাংশের ধারণা, এ স্রেফ লোক-দেখানো তল্লাশি। শাসক দলের অনুমতি না মেলা পর্যন্ত অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা যাবে না।

Advertisement

মঙ্গলবার কার্যত রাজ্যজুড়েই এ ক্ষোভ ছিল পুলিশের মধ্যে। কলকাতার ভবানী ভবনেও এ নিয়ে আলোচনা চলেছে দিনভর। রাজ্য পুলিশের এক ডিএসপি-র কথায়, “২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতা পুলিশের এসআই তাপস চৌধুরী দিনেদুপুরে গুলিতে খুন হয়ে গিয়েছিল। সে দিন থেকেই আতঙ্কে রয়েছি।” রাজ্য পুলিশের এই অসহায়তা বাম আমলেও ছিল। তৃণমূলের আমলে তার সূচনা ভবানীপুর থানা থেকে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুষ্কৃতীদের ছাড়ানো থেকে। এরপর কলেজ ভোটে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতার কথা না শোনায় সরিয়ে দেওয়া হয় পাটুলি থানার ওসিকে। মনোবলে আঘাত লাগে পুলিশের। নানা সময়ে ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার পুলিশ অফিসারদের খোলা মঞ্চে নেতাদের হেনস্থার সামনে পড়তে হয়। সর্বোপরি, গার্ডেনরিচে কলেজ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে এসআই তাপস চৌধুরীর গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও ভাবে শাসক দলের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ এক নেতা, যিনি ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে তৃণমূলে আসেন বিধানসভা নির্বাচনের পরে, তাঁর প্রশ্রয়েই শেখ আলিমকে গ্রেফতার করা যায়নি বলে অভিযোগ।

শেখ আলিমের বাবা শেখ জারদিস অবশ্য পুলিশকেই পাল্টা দায়ী করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “পুলিশ কয়লা পাচারকারীদের থেকে তোলা তুলছিল। আমার ছেলে তার প্রতিবাদ করায় পুলিশ তাকে এবং আমার আর এক ছেলেকে এই মামলায় জড়িয়েছে।”

বীরভূম জেলা পুলিশের একাংশের অভিযোগ, কেবল দুবরাজপুরে অমিতবাবুর ঘটনাই নয়। যে কোনও অপরাধীকে হেফাজতে নেওয়ার ক্ষেত্রে, এবং কেস ডায়রিতে বয়ান লেখা ও ধারা দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমাগত রাজনৈতিক চাপ চলছে। মার খেয়েও রাজনৈতিক চাপ ও পুলিশের উপরতলার কর্তাদের নির্দেশ না পাওয়ায় পাল্টা মার দিতে না পারার যন্ত্রণা হজম করছেন কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার কর্মীরা।

জেলা এসপি আলোক রাজোরিয়া যতই দাবি করুন, সব অভিযুক্তদের ধরতে সচেষ্ট পুলিশ, জেলা পুলিশের অন্দরে মঙ্গলবার প্রশ্ন উঠেছেই। জেলা পুলিশের এক অফিসারের কথায়। “থানায় কে আসা যাওয়া করছে, কে কখন কী বলেছে, জেনারেল ডায়েরিতে সমস্ত বিষয় লেখা থাকে। থানার জেনারেল ডায়েরি দেখে তদন্ত শুরু হলেই পুলিশের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন