—নিজস্ব চিত্র।
বিদ্যাসাগর কলেজে এমন তাণ্ডব দেখে কী যে কষ্ট পাচ্ছি আমরা শিক্ষকেরা, কী বলব! ৩৭ বছর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছি। এমএ পাশ করেই ১৯৬০-এ কাজ শুরু করি সেখানকার সংস্কৃত বিভাগে। সে সময়ে শিক্ষার পরিবেশটা অন্য রকমই ছিল। ’৯৭ সাল পর্যন্ত টানা সেখানেই কাজ করেছি। কলেজে পড়াশোনা ছাড়াও অনেক অনুষ্ঠান হত। ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন এবং ২৯ জুলাই, তাঁর মৃত্যুদিন খুবই যত্ন নিয়ে পালন করা হত। শিক্ষক ও পড়ুয়াদের পাশাপাশি আসতেন প্রাক্তনীরা। বহু সময়ে খেয়াল করেছি, বিদ্যাসাগরের মূর্তির আগে, দু’টো সিঁড়ি নীচে জুতো খুলে রেখে তাঁকে প্রণাম করে তবে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকতেন প্রাক্তনীরা। আমি নিজে তেমন না করলেও, অন্যদের শ্রদ্ধা জানানোর ভঙ্গিটা দেখে মুগ্ধ হতাম। এই কলেজের সঙ্গে আসলে আত্মিক যোগাযোগটা অনেকেরই খুব গাঢ়। আজ না কি সেই মূর্তিরই মাথাটা ভেঙে ফেলা হল! ভাবতেও লজ্জা করে।
লজ্জা করে অবশ্য লাভ নেই। ইতিহাস ভেঙে-গুঁড়িয়ে দেওয়ার রাজনীতি শুরু হয়েছে সর্বত্র। এত কিছু দেখার পরে, এই বয়সে এসে সত্যিই কারও নিন্দা করতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু চিন্তা হয়। ইতিহাস নষ্ট করে কি সত্যিই এগিয়ে যাওয়া যায়? অতীতকে অস্বীকার করে কি আগামীকে সুন্দর করা যায়? যায় না বলেই আমার বিশ্বাস।
সে কারণেই এমন তাণ্ডবের বুদ্ধি দেখলে আগামী প্রজন্মের জন্য ভাবনা হয়। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল এই কলেজ। শঙ্কর ঘোষ লেনের এই জমিটা তিনি নিজেই কিনেছিলেন। এ শহরের গর্বের জায়গা এটি। অল্প অল্প করে নিজে হাতে বিদ্যাসাগর এখানে গড়ে তোলেন পড়াশোনার জায়গা। সে কারণে আমাদের কলেজটা দেখতে একেবারেই আগেকার দিনের বসত বাড়ির মতো। যখন যেমন সম্ভব হয়েছে, তেমন ভাবে ঘর তোলা হয়েছে একটু একটু করে।
কখনও ভাবতে পারিনি, আমাদের সেই শান্তির প্রাঙ্গণে এমন তাণ্ডবের ছবি দেখতে হবে। মঙ্গলবার টেলিভিশনে যত বার ওই তছনছের ছবি দেখিয়েছে, বুকটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠেছে। ওই জায়গায় এমনটা মানায় না। এই কাজ হওয়ার কথাও নয়। এর আগেও নকশাল আমলে এমনই ধ্বংস দেখেছে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আরও বেশ কিছু মূর্তির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদ করে কলেজ স্কোয়ারের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এখন ছাত্রদের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তখনও সে কাজ ছাত্রেরাই করেছিলেন। টেলিভিশনে এ বারের তাণ্ডবের দৃশ্য দেখে ভাবনা হচ্ছিল, সেখানে আমাদের কলেজের ছাত্রেরাও আছেন কি না। তার পরে মনে হল, থাকতেই পারেন। এমন ক্ষেত্রে তো আর তাঁর পরিচয় ছাত্র হিসেবে
আবদ্ধ থাকে না। মানুষ যখন নিজেকে কোনও রাজনৈতিক দলের ভাল-মন্দের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন, তখন আর তাঁকে আলাদা করে কোনও কলেজের ছাত্র ভেবে আক্ষেপ করার মানে হয় না। নিজেদের কষ্টটা বাড়ে মাত্র।
নকশাল আমলের সেই ধ্বংসের পরেও আবার গঠনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন অনেকে। এ বারও হয়তো নেবেন। কিন্তু বারবার এই ভাঙা-গড়া চলতে থাকলে এগোনো যায় কি? বিদ্যাসাগরের কর্মফল হিসেবেই আজ আমরা মেয়েরা এত দূর এগিয়ে আসতে পেরেছি। লেখাপড়া শিখে, কাজকর্ম করে নিজেদের জীবন গড়েছি। তাঁরই তৈরি কলেজে কি না এমন পরিস্থিতি! সবটা থমকে থাকুক, কোথাও যেন এমনই
চেষ্টা চলছে। ইতিহাস, বিজ্ঞান— সবটা নিয়েই কেমন যেন ছেলেখেলা চলছে। গোটা দেশেই তা হচ্ছে। সকলকেই দেখতে হচ্ছে সবটা। কিন্তু নিজেদের কলেজে এমন হলে বড্ড মন খারাপ হয়। কাজের জায়গাটা ভালবাসারও জায়গা ছিল যে!
এক বার কলেজের একটি অনুষ্ঠানে এসে এক প্রাক্তন অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘আমরা সকলে বিদ্যাসাগর গোত্র’! অর্থাৎ, আমাদের একে-অপরকে আলাদা করে চিনতে লাগে না। এই কলেজই আমাদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের সকলের পরিচয় এই কলেজ। সকলের ভালবাসার জায়গাটাও এক। ভাবতেও অবাক লাগে, সেই জায়গাটায় এমন তাণ্ডব চালানোর সাহস পেল কী করে এত জনে! যদিও সময় এমন দিকে নিয়ে যাচ্ছে, রাজনীতিতে বুঝি আর বিস্ময়ের সুযোগ নেই।
(লেখিকা বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তন শিক্ষিকা)