কেউ কথা রাখেনি, অভাবই সঙ্গী কোরপানের স্ত্রীর

গত বার প্রতিবন্ধী দিবসে তাঁকে কলকাতার রানি রাসমণি রোডে মঞ্চে তোলা হয়েছিল। রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর সেই সভায় দাঁড়িয়ে তিনি স্বামীর খুনের শাস্তি চেয়েছিলেন।

Advertisement

নুরুল আবসার

উলুবেড়িয়া শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৪১
Share:

দুই সন্তানের সঙ্গে আরজিনা বেগম। উলুবেড়িয়ায়। ছবি: সুব্রত জানা।

গত বার প্রতিবন্ধী দিবসে তাঁকে কলকাতার রানি রাসমণি রোডে মঞ্চে তোলা হয়েছিল। রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর সেই সভায় দাঁড়িয়ে তিনি স্বামীর খুনের শাস্তি চেয়েছিলেন।

Advertisement

আরও একটা প্রতিবন্ধী দিবস চলে গেল বৃহস্পতিবার। কেউ তাঁর খোঁজ নেয়নি। মামলার কী হাল, সেটাও কেউ জানায়নি নীলরতন সরকার হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের মারে হত কোরপান শাহের স্ত্রী আরজিনা বিবিকে। গত বছর ১৬ নভেম্বর মানসিক প্রতিবন্ধী কোরপান যখন খুন হন, চার ছেলেমেয়ের মা আরজিনা তখন অন্তঃসত্ত্বা। দু’মাস বাদে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়। আরজিনা এখন জরির কাজ করেন।

উলুবেড়িয়ার বাণীতবলা শাপাড়ায় একটি কুঁড়েতে দু’টি ঘর। এবড়ো-খেবড়ো মাটির দেওয়াল, টালির চাল। বারান্দায় টালিও নেই, ত্রিপল। একটি ছিল রান্নাঘর, অন্যটি থাকার। কয়েক মাস হল, শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পাঁচ সন্তান নিয়ে মায়ের বাড়ির রান্নাঘরে এসে উঠেছেন বছর পঁচিশের আরজিনা। কোরপানের বাড়িতে তালা ঝুলছে। আরজিনার মা রিজিয়া বিবি বলেন, ‘‘কোথায় রাখতাম ওদের? অন্য ঘরে বিধবা মেজো মেয়ে এসে উঠেছে। আমি তো বাইরে দালানে শুই।’’

Advertisement

তখন বেলা ১০টা। মাটির দাওয়ায় আদুল গায়ে বসে সময় ভাত খাচ্ছে আরজিনার ছেলেমেয়েরা। তরকারির বালাই নেই। মাছি ভনভন করছে। রিজিয়া বলে চলেন, ‘‘কপাল খারাপ বাবা। প্রথমে মেজো মেয়ে বিধবা হয়ে ফিরল। তার পর গেল ছোট জামাই কোরপান। জরির কাজ করে মেয়ে ক’টা পয়সাই বা পায়? এই বয়সেও আমায় তাই ভিক্ষা করতে হচ্ছে!’’

কোরপানের মৃত্যুর পরে কিছু সাহায্য এসেছিল। রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম ১ লক্ষ টাকা দেয়। কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্রও ২০ হাজার টাকা দেন। সেই টাকা সন্তানদের জন্য ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখেছেন আরজিনা। তা বাদেও যাতে তাঁদের দিন চলে যায়, তার জন্য নানা সাহায্যের আশ্বাস দেন অনেকে।

যেমন ওমপ্রকাশবাবু বলেছিলেন, সরকার যদি ক্ষতিপূরণ না দেয়, তিনি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ভাতা দেবেন আরজিনাকে। মাসিক ভাতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমতার কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্রও। খুনিদের শাস্তি চেয়ে এবং কোরপানের স্ত্রীর চাকরির দাবিতে রাষ্ট্রপতি এবং কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছ পর্যন্ত দরবার করে রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী এবং ‘আমরা আক্রান্ত’ সংগঠন। তাদের সঙ্গে দিল্লিও যান কোরপানের ভাই। কিন্তু কিছুই মেলেনি। কোরপানের বড় ছেলে, বছর বারোর আজিত শাহকে উদয়নারায়ণপুরে আল আমিন মিশনে ভর্তি করে নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দু’মাস সেখানে থাকার পরে সে চলে এসেছে। এখন সে মায়ের সঙ্গে জরির কাজ করে। আরজিনার আক্ষেপ, ‘‘স্বামী খুন হওয়ার পরে কয়েক দিন পর্যন্ত প্রচুর মানুষ বাড়িতে এসেছিলেন। পরে আর কেউ কোনও খোঁজ নেননি। জানিই না স্বামী খুনের মামলার কী হাল!’’

কেন কেউ কথা রাখলেন না? রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর হাওড়া জেলা সম্পাদক অজয় দাসের দাবি, ‘‘কোরপানের স্ত্রীকে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তাঁকে মুকুন্দপুরে প্রতিবন্ধী গ্রামে রাখারও ব্যবস্থা হয়। কিন্তু পরে দেখলাম, ওঁরাই আমাদের কাছে আসছেন না।’’ ওমপ্রকাশবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমিই ওখানে প্রথম যাই। কিছুটা সাহায্যও করি। কিন্তু পরে ওঁরা নিজেরাই আর উৎসাহ দেখালেন না। তৃণমূল নেতারাও বারবার যেতে শুরু করলেন। আমি তো ভেবেছিলাম, ওঁরাই টাকাকড়ি দিয়েছেন!’’

স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক পুলক রায় পাল্টা বলেন, ‘‘আমরাই কোরপানের দেহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে আনি, কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু পরে দেখলাম, বিষয়টিতে রাজনীতি ঢুকে গিয়েছে। সবার দৌড় তো দেখা গেল! তবে পরিবারটি যাতে বঞ্চিত না হয়, তা আমরা দেখব।’’

কে কবে দেখেন, সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন