যাদবপুর কাণ্ডের প্রতিবাদে দিল্লির বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ। ছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া-সহ অনেকেই। ছবি: প্রেম সিংহ
উত্তেজনায় থরথর কাঁপছিল অধুনা প্রবাসী বাঙালি তরুণের গলা। “বহিরাগত কাকে বলছে ওরা? ধরুন আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়ি। আমি যাদবপুর ক্যাম্পাসে গেলেই কি বহিরাগত হয়ে যাব! আর বহিরাগত মানেই আমি কি গুন্ডা, যে পুলিশ দিয়ে পেটাতে হবে?”
নয়াদিল্লির হেইলি রোডে বঙ্গভবনের উল্টোদিকের ফুটপাথ। কেউ কেউ সেখানেই বসে আর্ট পেপারের রোল খুলে ফেল্ট পেনে পোস্টার লিখছিলেন, কেউ খুলে বসেছিলেন ল্যাপটপ। তরুণটির সঙ্গে দেখানেই দেখা। যাদবপুরের প্রাক্তনী, কর্মসূত্রে এখন গুড়গাঁওয়ে। শনিবার তিনি ও তাঁর মতো আরও বেশ কয়েক জন দুপুর গড়ানোর আগেই হাজির হয়ে গিয়েছেন রাজধানীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথিশালার সামনে।
জমায়েতটা ওখানেই। হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজা কলকাতার রাজপথে যখন পা বাড়াচ্ছে যাদবপুরের মিছিল, তখন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের গঙ্গা ধাবা-র সামনে জড়ো হচ্ছিলেন সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা। কেউ প্রাক্তন যাদবপুর, আবার কেউ কোনও দিন কলকাতাই চোখে দেখেননি। কিন্তু হাজার দেড়েক কিলোমিটার উজিয়ে কলকাতার কলরব ঠিকই পৌঁছেছে।
যাদবপুরের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর পদত্যাগের দাবিতে বৃহস্পতিবারই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেসিডেন্ট কমিশনারকে স্মারকলিপি দেয় ছাত্র সংগঠন আইসা। আজ আইসা, এসএফআই, ডিএসএফ-সহ দলমত নির্বিশেষে মোট সাতটি ছাত্র সংগঠন যাদবপুরের ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ জমায়েতের ডাক দেয়। জেএনইউ ক্যাম্পাস থেকে বাসে-অটোয়-ম্যাটাডরে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সেই দলটাই পৌঁছে যায় বঙ্গভবনের সামনে। যেখানে অপেক্ষা করছিলেন ওই প্রাক্তনী তরুণের মতো বেশ কিছু প্রতিবাদী।
জেএনইউ ক্যাম্পাসের যে কোনও প্রতিবাদী মিছিলেরই চালু স্লোগান ‘হাল্লা বোল’। সেই স্লোগান উঠল বঙ্গভবনের সামনেও। মাঝে মাঝে হাততালি দিয়ে নাটকের গান। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজিতে লেখা পোস্টার ‘পুলিশি নির্যাতন কেন হবে ক্যাম্পাসে?’ ‘কেন এর পরেও পদত্যাগ করবেন না উপাচার্য?’ তারই মধ্যে বেশ কিছু পোস্টারে নতুন লব্জ ‘বাউন্সার’। ‘ক্যাম্পাস থেকে বাউন্সার হটাও’। লক্ষ্য কি মঙ্গলবার রাতের ‘গেঞ্জি পুলিশ’ বাহিনী? আর শুধু জেনএনইউ নয়, চোখে পড়ল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়েরও কিছু মুখ। ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, ছিলেন কিছু শিক্ষকও। ইতিমধ্যে খবর আসে, বঙ্গভবনে আসার পথে তুঘলক রোড থানার সামনে জেএনইউ-এর বাস আটকে দিয়েছে পুলিশ। বাস থেকে নাকি প্রতিবাদীদের নামতেও দেওয়া হচ্ছে না। তা নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ উত্তপ্ত কথা চালাচালি চলে।
প্রতিবাদী জমায়েত যে হবে, খবর ছিল পুলিশের কাছে। তবে হিসেবে ভুল হয়েছিল তার কলেবর নিয়ে। বঙ্গভবনের সামনে তাই প্রথম দিকে কতকটা আলসে মেজাজেই দাঁড়িয়েছিল একটিমাত্র পুলিশ জিপ। ভিড় ক্রমেই বাড়ছে দেখে বসে লোহার ব্যারিকেড। খবর যায় পুলিশ কন্ট্রোলে, ‘চল্লিশ নয়, অন্তত চারশো লোক জমেছে।’ পৌঁছয় র্যাফ। তবে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যায়নি। উত্তেজনায় লোহার ব্যারিকেড ধরে ঝাঁকুনি দিতে দেখা গিয়েছে অনেককে। তবে মাথা ঠান্ডা রেখেই পরিস্থিতি সামলেছে পুলিশ।
গোটা সময়টায় আগাগোড়া ছবি তুলে সোশ্যাল সাইটে আপলোড করে যাচ্ছিলেন অনেকে। খবর আসছিল কলকাতার মিছিল নিয়েও। বঙ্গভবনের সামনে থেকে অশোক রোড ধরে যন্তরমন্তরে গিয়ে শেষ হয় মিছিল। মিছিল শেষে দু-এক জন জানালেন, আজকের কর্মসূচি শেষ হলেও জারি থাকবে প্রতিবাদ। যাদবপুরের প্রাক্তনীদের অধিকাংশ শহরেই শাখা রয়েছে। উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে আচার্য-রাজ্যপালের কাছে চিঠি লিখছেন তাঁরাও।
কাল, রবিবার বেঙ্গালুরুর টাউন হলে অবস্থান বিক্ষোভ করবেন যাদবপুর-সহ কলকাতার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনীরা। আজ আবার হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং হায়দরাবাদের ‘ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউনিভার্সিটি’-র ছাত্রছাত্রীরা যাদবপুর কাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখান।
উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারত হয়ে উত্তরবঙ্গ। সেই যাদবপুর ঢেউ। কলকাতার মতোই বৃষ্টি মাথায় করে মিছিল এগোচ্ছিল শিলিগুড়ির রাস্তায়। মূলত ছাত্রছাত্রীদের সেই মিছিলের সামনে ব্যানার ‘যাদবপুরে মার খেয়েছি, শিলিগুড়িতে জোট বেঁধেছি’। সেই মিছিলও যত এগিয়েছে, সাধারণ মানুষের ভিড়ে কলেবর বেড়েছে তার। সেবক রোড ঘুরে মিছিল পৌঁছয় হিলকার্ট রোডে। এ দিকে, প্রতিবাদে সরব হয়েছে পাহাড়ের ছাত্র সংগঠন ও ডুয়ার্সের আদিবাসী সংগঠনগুলিও। দার্জিলিঙে পথে নামার কথা জানিয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ছাত্র সংগঠন বিদ্যার্থী মোর্চা। তাদের মুখপাত্র সন্দীপ ছেত্রী বলেছেন, “যাদবপুরের যা ঘটেছে, তার দায় রাজ্য সরকারকে নিতে হবে।” আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সম্পাদক তেজকুমার টোপ্পোর কথায়, “প্রতিবাদ করার অধিকারও সকলের রয়েছে। এ কোন রাজ্যে আমরা রয়েছি, লড়াই করে কোন পরিবর্তন আনলাম!”