দিব্যি দৌড়চ্ছে অচল নোট!
বহু চেষ্টায় প্রশাসন যা পারেনি, এখন ম্যাজিকের মতো তা-ই ঘটছে। পুরনো পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট নিয়ে হইহই করে পঞ্চায়েত অফিসে ছুটছেন মহিলারা। একটাই দাবি, ‘‘ও স্যার, আমার টাকাটা আগে জমা নিয়ে বাড়িতে শৌচাগারের ব্যবস্থা করে দিন!’’
মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, নওদা, সর্বাঙ্গপুর এলাকায় অবস্থা এমনই যে, সেই টাকা জমা নিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। অথচ ক’দিন আগে পর্যন্তও যখন পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে বাড়িতে শৌচাগার তৈরির কথা নানা ভাবে বোঝানো হয়েছে, কেউ রা কাড়েননি। দিন কয়েক আগে প্রশাসন জানিয়ে দেয়, পুরনো পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট জমা দিয়েও শৌচাগারের জন্য আবেদন করা যাবে। ছবিটা বদলে গিয়েছে তার পরেই।
দশ, পঞ্চাশ, একশো— সংসারের খরচ চালিয়ে হাতে যে টাকাটা বাঁচে সেটাই লক্ষ্মীর ভাঁড়ে চালান করে দেন সর্বাঙ্গপুরের যূথিকা মণ্ডল, নওদার আরতি মণ্ডলেরা। পরে এক দিন ভাঁড় ভেঙে কোনও দোকানে দিয়ে পাঁচশো বা এক হাজারের নোট নেওয়া। সেই টাকা ফের জমা হয় আর এক ভাঁড়ে।
এই ভাবেই চলছিল। ৮ নভেম্বর রাতে গোলটা বাধালেন নরেন্দ্র মোদী। বেমক্কা ঘোষণা করে দিলেন, পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট অচল। যূথিকা, আরতিদের মাথায় বজ্রাঘাত।
এ দিকে, কয়েক দিন ধরে শুরু হয়েছে আর এক বিপদ। ভোরের আলো ভাল করে ফুটতে না ফুটতেই পঞ্চায়েতের লোকজনকে নিয়ে গাঁয়ের মাঠে হাজির বিডিও এবং মহকুমাশাসক। মাঠে কাউকে শৌচকর্ম করতে দেখলেই সোজা পাকড়াও করে একপ্রস্ত স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং নির্মল বাংলার পাঠ। সে এক জ্বালা! পুরুষরা মানে-মানে সরে পড়লেও লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল মহিলাদের।
বেলডাঙার বিলকিস বেগম বা নওদার ভানুমতি মণ্ডলরা জানাচ্ছেন, বাড়িতে শৌচাগার না থাকায় সবচেয়ে অসুবিধায় পড়তে হয় তাঁদেরই। তার উপরে মাঠে গিয়ে ধরা পড়লে আর এক অপমানজনক পরিস্থিতি। তাঁদের কথায়, ‘‘তাই যখনই জানতে পেরেছি যে, পুরোনো পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট ওরা নেবে, আর দেরি করিনি। সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চায়েতে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে এসেছি।’’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বছরখানেক আগে কেউ ৯০০ টাকা জমা দিলেই শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হতো। পরে টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০০। সেই থেকে অনেকেই বাড়িতে শৌচাগার তৈরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কষ্ট করে এই টাকাটুকু খরচ করলে সব দিক থেকেই যে ভাল, এ কথা বোঝানো যায়নি অনেককেই। মাঠে যাওয়া বন্ধ হয়নি।
বহরমপুরের মহকুমাশাসক দিব্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘নোট বাতিল এবং মাঠ অভিযান, এই দুইয়ের চাপে কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলেন ওই গ্রামের লোকজন। তখন তাঁরাই আমাদের কাছে জানতে চান, পাঁচশো বা হাজার টাকার নোট নেওয়া হবে কি না। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে সে ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়। তাতেই সুফল মিলছে।’’ বেলডাঙা ১ ও নওদা ব্লকে এই ক’দিনে ৪৮৭ জন শৌচাগারের জন্য টাকা জমা দিয়েছেন।
সর্বাঙ্গপুর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান আরএসপির বিকাশ মণ্ডল বলছেন, ‘‘জমানো টাকা নিয়ে এগিয়ে আসছেন মহিলারাই। আমাদের পঞ্চায়েতেই ৭৭ জন এসে শৌচাগারের জন্য টাকা জমা দিয়ে গিয়েছেন।’’
এখন যূথিকা, আরতি, বিলকিসরা হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘জমানো টাকার গতি হল, আমরাও লজ্জা থেকে রেহাই পেলাম। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!’’
অচল টাকাতেও যে বাংলা নির্মল হয়, কে জানত!