‘পূবে গেলে মেয়েগুলো বেঁচে যেত’

কেন বাইরে কাজে যেতে হয়? একশো দিনের কাজ কি পাওয়া যায় না? জামিরা গ্রামের অবনী মুর্মু, কাশীনাথ মাহালি, উদলবনির চিন্তামণি হেমব্রমদের কারও অভিযোগ, একেবারেই কাজ পাননি। কেউ বা দাবি করছেন, গত বছরে মাত্র চার দিন কাজ পেয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বান্দোয়ান শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৯ ০০:৩০
Share:

শোকার্ত: বান্দোয়ানের উদলবনি গ্রামে শেফালির বাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র

জমিজমা বিশেষ নেই। দিনমজুরি করেই চলে সংসার। এ বার বৃষ্টি তেমন না হওয়ায় চাষের কাজও জোটেনি। তাই মুর্শিদাবাদের সালারে চালকলে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে গিয়েছিলেন বান্দোয়ান ও বোরো থানার কিছু মহিলারা। বুধবার তুমুল বৃষ্টিতে নির্মীয়মাণ দেওয়াল ভেঙে মারা গেলেন তিন জন। আহত হয়েছেন ১৩ জন। তাঁদের মধ্যে অবশ্য পুরুলিয়া জেলার কেউ নেই। ওই মৃত্যুর খবর পেয়ে তিন গ্রামেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদে রওনা দিয়েছেন মৃতদের পরিজনেরা। দেহের ময়না-তদন্ত হলেও শুক্রবার পর্যন্ত গ্রামে দেহ ফেরেনি।

Advertisement

বান্দোয়ানের উদলবনি গ্রামের শেফালি হেমব্রম (২৪) মাস দেড়েক আগে গ্রামেরই দুই মহিলা সাবিত্রী মান্ডি ও তাঁর মেয়ে মালতি মান্ডির সঙ্গে কাজ করতে গিয়েছিলেন সালারে। রবিবার ফিরে আসেন মালতি। সাবিত্রী এখনও সালারেই। তাঁদের সঙ্গেই যান বোরো থানার বড়গোড়া গ্রামের চিন্তামণি টুডু (৩৫), জামিরা গ্রামের সরস্বতী মাহালি (২১)। গত বছর বর্ধমানে চাষের কাজে গিয়ে তাঁদের মধ্যে পরিচয় হয়েছিল।

শুক্রবার উদলবনি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রাম জুড়ে থমথমে পরিবেশ। অ্যাসবেস্টর্সের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরের ভিতরে শুয়েছিলেন শেফালির মা। তাঁর দাদা আলোক হেমব্রম কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘বোন যে আর নেই, মাকে সে খবর দেওয়া হয়নি। শুধু জানে, বোন আহত হয়েছে।’’ তিনি জানান, তিন ভাই-বোনের মধ্যে শেফালি মেজো। জমিজমা খুবই সামান্য। বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। মূলত দুই ভাই জমির চাষবাস দেখেন। শেফালি এলাকার মেয়েদের সঙ্গে দিনমজুরি করতেন। তিনি জানান, বুধবার দুপুর তিনটের সময় তাঁরা দুর্ঘটনার খবর পান। অন্য দুই মৃতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বৃহস্পতিবার ভোরে শেফালির বাবা অজিত হেমব্রম ও কাকা গুরুপদ হেমব্রম মুর্শিদাবাদে রওনা দিয়েছেন।

Advertisement

পড়শি মহিলা অঞ্জলি হেমব্রম, নির্মলা হেমব্রমেরা বলেন, ‘‘পরিবারের লোকেদের ভাল রাখতে শেফালি খুবই পরিশ্রম করত। তার কপালে যে এমনটা যে রয়েছে, আমরা ভাবিনি। খবর পাওয়ার পর থেকেই ওঁদের বাড়িতে উনুন জ্বলেনি। শেফালির মা তিন দিন ধরে শুধু জল খেয়ে রয়েছেন। মেয়ের মৃত্যুর খবরটা শোনার পরে কী ভাবে যে তিনি শোকের ধাক্কা সামলাবেন, জানি না।’’

চিন্তামণির বাবা-মা অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছেন। দাদাও পাঁচ বছর আগে মারা গিয়েছেন। বৌদি ও দুই কিশোর ভাইপোর সঙ্গে তিনি থাকতেন। জমি জমা কিছু নেই। মূলত তাঁর আয়েই সংসার চলে। তাঁর বৌদি সম্বরী টুডু বলেন, ‘‘জমি নেই। বিধবা ভাতাও পাই না। ননদ আমাদের অভিভাবকের মতো ছিলেন। এ বার সংসারটা বোধহয় ভেসে যাবে।’’ তাঁর বড় ছেলে সুশান্ত মুর্শিদাবাদে গিয়েছেন।

সরস্বতীর বিয়ে হয়েছিল বছর দুই আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের রামগড়ে। বনিবনা না হওয়ায় মাসখানেক পরেই তিনি বাপের বাড়িতে ফিরে আসেন। দিনমজুরি করতেন। তাঁর জেঠতুতো দাদা আনন্দ মাহালি বলেন, ‘‘এলাকায় চাষবাস নেই। বাইরে বাইরে কাজ করত সরস্বতী। খবরটা শুনে আমরা মুষড়ে পড়েছি। ওর মাকেও আসল খবরটা জানানো হয়নি।’’

কেন বাইরে কাজে যেতে হয়? একশো দিনের কাজ কি পাওয়া যায় না? জামিরা গ্রামের অবনী মুর্মু, কাশীনাথ মাহালি, উদলবনির চিন্তামণি হেমব্রমদের কারও অভিযোগ, একেবারেই কাজ পাননি। কেউ বা দাবি করছেন, গত বছরে মাত্র চার দিন কাজ পেয়েছেন।

বড়গোড়া ও জামিরা গ্রাম আঁকড়ো-বড়কদম পঞ্চায়েতের অধীনে। ওই পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের শিশির মণ্ডলের অবশ্য দাবি, ‘‘২০১৮-’১৯ অর্থবর্ষে আমাদের পঞ্চায়েতে ৫৬.৮ কর্মদিবস তৈরি হয়েছে। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত ২৪ কর্মদিবস তৈরি হয়েছে। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, এমন অভিযোগ আমাদের কাছে করেননি।’’ তিনি জানান, ওই পরিবারগুলিকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন