আগের জেলা পরিষদের একটি স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ মজা করে বলতেন, সভাধিপতি যদি জেলার মুখ্যমন্ত্রী হন তা হলে তিনি দফতরের মন্ত্রী। সেই তুলনাটাই আজ বিরোধীদের কাজে লাগছে পরিস্থিতি বোঝাতে। পুরুলিয়ার জেলা সভাধিপতি বাছাই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও গঠিত হয়নি ‘মন্ত্রিসভা’, থু়ড়ি স্থায়ী সমিতি। সেটা বাদ দিয়ে সভাধিপতির একা একা অনেক কাজই করার জো নেই। সেই কথা বলে বিরোধীরা দাবি করছেন, জেলা পরিষদ এখন এক প্রকার নিস্ক্রিয় হয়েই রয়েছে।
কেন স্থায়ী সমিতি গড়া হচ্ছে না? প্রশাসন সূত্রের খবর, পুরুলিয়ায় এখনও পর্যন্ত চারটি পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড গঠন হয়নি। পদাধিকারবলে সমিতির সভাপতিরা স্থায়ী সমিতির সদস্য। সমিতি গঠনে ভোটাভুটি হলে তাঁদের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। ফলে, যতক্ষণ সমস্ত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নির্বাচন না হয়, ততক্ষণ জেলা পরিষদের স্থায়ী সমিতি গঠন ঝুলে থাকছে।
এই স্থায়ী সমিতির মাধ্যমেই জেলাপরিষদ কাজের বার্ষিক পরিকল্পনা করে। সেটাও এখন করা যাচ্ছে না। বিরোধী দলগুলি অভিযোগ তুলছে, জেলা জুড়ে হোঁচট খাচ্ছে উন্নয়নের কাজকর্ম। বিরোধীদের অভিযোগ মানতে নারাজ হলেও জেলা পরিষদের তৃণমূলের সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘স্থায়ী সমিতি গঠন না হওয়ায় নতুন কাজের পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
বস্তুত জেলার ৪৩টি পঞ্চায়েত ও ৪টি পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড গঠন না হওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকেই কাঠগড়ায় তুলছেন বিরোধীরা। জেলা পরিষদের স্থায়ী সমিতির ব্যাপারেও তাঁদের তিরটা জেলা প্রশাসনেরই দিকে। বিজেপি এবং কংগ্রেসের জেলা নেতারা অভিযোগ করছেন, প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের একাংশ শাসকদলকে রাজনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিতে এই গড়িমসি করছে।
বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসনের কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে ওরা শাসকদলের হয়েই কাজ করছে। জেলার উন্নয়নটা যে মূল কাজ, সেটাই কারও মনে নেই।’’ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জেলার উন্নয়নে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা পুরোপুরি নেতিবাচক।’’ এই সমস্ত অভিযোগ নিয়ে অবশ্য কোনও মন্তব্যই করতে নারাজ প্রশাসনের কর্তারা।
জেলা পরিষদে স্থায়ী সমিতি দশটি— অর্থ, পূর্ত, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারী ও শিশু কল্যাণ, বন ও ভূমি, মৎস্য ও প্রানী সম্পদ, কৃষি ও সেচ, খাদ্য এবং ক্ষুদ্র শিল্প আর বিদ্যুৎ। নিজের নিজের ক্ষেত্রে কাজের রূপরেখা তৈরি করে ওই তারা। বার্ষিক পরিকল্পনা হয়। নিজস্ব বাজেট হয়। সেই বাজেট পাঠানো হয় অর্থ স্থায়ী সমিতির কাছে। পরে পূর্ণাঙ্গ বাজেট তৈরি করে জেলা পরিষদের সাধারণ সভায় পেশ করা হয়। সেখানে অনুমোদনের পরে শুরু হয় কাজ।
প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বছরে কয়েকশো কোটি টাকার বাজেট থাকে জেলা পরিষদের। এমনিতে সভাধিপতি নির্বাচনের তিন মাসের মধ্যে স্থায়ী সমিতি গঠন করার নিয়ম। তবে সচরাচর তার অনেক আগেই সমিতিগুলি গঠন হয়ে যায়। পুরুলিয়া জেলা পরিষদের প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ তথা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, এ বারের স্থায়ী সমিতি এখনও তৈরি না হওয়াতে পুরো প্রক্রিয়াটাই স্থগিত হয়ে রয়েছে।
জেলা পরিষদে কাজ হয় দরপত্র ডেকে। সেটা ডাকে টেন্ডার কমিটি। নিয়ম অনুযায়ী, টেন্ডার কমিটিতে থাকেন সভাধিপতি, সরকারি আধিকারিক, বিরোধী দলনেতা ও দু’জন স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ। সেই কমিটিও এখন ঝুলে রয়েছে। ফলে ঝুলে রয়েছে কাজের বরাতও। তবে নতুন সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, টেন্ডার কমিটি গঠিত না হওয়ায় এখনও খুব একটা সমস্যা হয়নি। তাঁর দাবি, গত বছরের অনুমোদিত যে সমস্ত প্রকল্পগুলির টেন্ডার হলেও কাজ হয়নি, আপাতত সেগুলোই করানো হচ্ছে।
তবে স্থায়ী সমিতি গঠনের দরকার যে দিন দিন বা়ড়ছে, সে কথা অন্দরের আলোচনায় মানছেন শাসকদলের কিছু নেতাই। লোকসভা নির্বাচন সামনেই। এই অবস্থায় জেলা পরিষদের মাধ্যমে জোর কদমে কাজ শুরু করাটা জরুরি বলে বুঝছেন তাঁরা। জেলা পরিষদে হাতে গোনা আসনে জিতেছে বিরোধীরা। শাসকদলের নেতাদের মতে, সমস্ত স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ তৃণমূলেরই হবে। সেটা ঝুলে থাকায় আখেরে দলের লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না বলে মনে করছেন তাঁরা।
সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফরের পরেই জেলায় স্থগিত থাকা সমিতি ও পঞ্চায়েতগুলিতে বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে প্রশাসন। আর সমিতির বোর্ড গঠন হলেই একে একে স্থায়ী সমিতিও গঠিত হয়ে যাওয়ার কথা।