বাদাম চষে লাভের মুখ দেখছে চূড়ো

বছরের এই সময় চূড়োর গ্রামে গেলেই ছবিটা চোখে পড়বে। গ্রাম লাগোয়া ফসলের খেত সবুজ চাদরে ঢাকা। মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এক ধরনের শাক জাতীয় ছোট ছোট গাছ। বিস্তীর্ণ ফসলের খেতের বিভিন্ন জায়াগায় যত্ন করে চলছে শেষ বেলার সেচ দেওয়ার কাজ। অযত্ন হলে পাছে ফলন মার খায়। না, কোনও সব্জি চাষ নয়। এই যত্ন বাদাম চাষের জন্য। অপেক্ষা শুধু আর দিন দশেকের। আর তার পরেই চাষিদের ঘরে ঘরে উঠবে মরসুমের অন্যতম অর্থকরী ফসল— বাদাম!

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

খয়রাশোল শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৫ ০২:০৪
Share:

অজয় ঘেঁষা জয়দেব অঞ্চলেও কিছু এলাকায় বাদাম চাষ হয়। —নিজস্ব চিত্র।

বছরের এই সময় চূড়োর গ্রামে গেলেই ছবিটা চোখে পড়বে। গ্রাম লাগোয়া ফসলের খেত সবুজ চাদরে ঢাকা। মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এক ধরনের শাক জাতীয় ছোট ছোট গাছ। বিস্তীর্ণ ফসলের খেতের বিভিন্ন জায়াগায় যত্ন করে চলছে শেষ বেলার সেচ দেওয়ার কাজ। অযত্ন হলে পাছে ফলন মার খায়। না, কোনও সব্জি চাষ নয়। এই যত্ন বাদাম চাষের জন্য। অপেক্ষা শুধু আর দিন দশেকের। আর তার পরেই চাষিদের ঘরে ঘরে উঠবে মরসুমের অন্যতম অর্থকরী ফসল— বাদাম!

Advertisement

জেলা কৃষি দফতরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু খয়রাশোলেই ৮০০ বিঘে জমিতে হয় এই বাদাম চাষ। খয়রাশোলে অজয় এবং হিংলোর মধ্যবর্তী যে গ্রামগুলিতে বাদাম চাষ হয়ে থাকে, সেগুলির মধ্যে প্রধান এই চূড়োর। চূড়ো গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, প্রায় ৬০০ বিঘে জমিতে বাদাম লাগান গ্রামের একশো ঘর কৃষিজীবীদের প্রায় সকলেই। এ ছাড়াও এই জেলায় খয়রাশোলের বিলাতি, মুক্তিনগর, পারুলবোনা, চাপালা, চন্দননগরে, দুবরাজপুরের পলাশডাঙা চর এবং ইলামবাজারের অজয় ঘেঁষা জয়দেব অঞ্চলেও কিছু এলাকায় বাদাম চাষ হয়ে থাকে।

এই মরসুমে কেন বাদাম চাষ?

Advertisement

চূড়োর গ্রামের বাদাম চাষি হীরামোহন মজুমদার, মনোজিৎ গায়েন, চিত্ত মজুমদার, বাসুদেব মণ্ডলেরা জানাচ্ছেন, গত ৩৫-৪০ বছর ধরে এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বাদাম চাষ হয়ে আসছে। কেউ দু’বিঘা, কেউ দশ বিঘা— যে যেমন পেরেছেন লাগিয়েছেন। এই বাদাম চাষ করার নেপথ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তাঁদের কারণ রয়েছে। চিত্তবাবুদের বক্তব্য, অজয় ঘেঁষা হওয়ায় মাটির চরিত্র মাটি বেলে-দোঁয়াশ। বাদাম চাষে এই ধনের জমি খুবই উপযুক্ত। দ্বিতীয়ত, দুই, মূলত আলু উঠে যাওয়া এবং আমন ধান চাষের আগে যে সময়টুকু থাকে, সেই মাঝের সময়ে জমি খালি না রেখে বাদাম চাষ করে টাকা উপার্জন করতে পারি। তিন, চাষে খরচ ও পরিশ্রম দুই-ই তুলনায় কম। অথচ বেশ ভাল লাভ হয় বাদাম বিক্রি করে। চার, বাদাম বিক্রির জন্য কোথাও যেতে হয় না। বাদাম তেল তৈরির মিল বা চানাচুর প্রস্তুতকারক কোম্পানিরা নিজেরাই চাষিদের ঘর থেকে সরাসরি বাদাম কিনে নিয়ে যায়। প্রয়োজনে বাদাম বেশ কয়েক মাস ঘরে মজুত করেও রাখা সম্ভব।

কী ভাবে হয় এই চাষ?

ওই চাষিরাই জানাচ্ছেন, বীজ পোঁতা থেকে ফসল ঘরে তুলতে মোট ১০০-১২০ দিন সময় লাগে। ফসল লাগানোর সব চেয়ে আদর্শ সময় ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ। লাল ও সাদা মূলত দু’ধরনের বাদাম চাষ করা হয়। সাদা বাদামের ফলন বেশি, দাম কম। অন্য দিকে, লাল বাদামের ক্ষেত্রে তার ঠিক উল্টো।

খয়রাশোলে এই দু’ধরনের বাদামই চাষ হয়ে থাকে। তবে, চূড়োরের চাষিরা মূলত সাদা বাদাম চাষ করে থাকেন। এ বার দশ বিঘে জমিতে বাদাম লাগিয়েছেন দেবব্রত মণ্ডল। তিনি বলছেন, ‘‘এক বিঘে জমিতে ২০-২৫ কিলোগ্রাম বাদাম বীজ ও সার নিয়ে খরচ পড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আলু উঠে যাওয়ার পরে চাষ করলে খরচ আরও কিছুটা কম হয়। জমি তৈরি করে বীজ পোঁতার ১০ দিন পরে গাছগুলি মাটির উপরে আসে। দিন কুড়ি পরে থেকেই ফুল আসতে শুরু করে গাছে।’’ ইতিমধ্যেই দেবব্রতবাবুর খেতে বাদাম ফলেছে। আর দিন দশেক ধরে শুধু বাদামের দানাগুলিকে বাড়তে দেওয়া হবে, যাতে ফলন ঠিকঠাক হয়। সপ্তাহে দুটো করে সেচ লাগে। এ বার গ্রীষ্মের প্রথম দিকে মাঝে মধ্যেই বৃষ্টি হওয়ায় সেচ কম লেগেছে। গ্রামের বাদাম চষিরা বলেন, ‘‘ভাল ফলন হলে বিঘা প্রতি সাড়ে তিন থেকে চার কুইন্ট্যাল বাদাম ফলে। যার বাজারদর কুইন্ট্যাল প্রতি তিন হাজার টাকা।’’

এলাকার বাদাম চাষিরা জানাচ্ছেন, মে মাসের শেষ দিক থেকেই ফসল ঘরে তোলার পালা। সেই সময় গ্রামের পুরুষ-মহিলা, সকলেই ব্যস্ত থাকেন। বাদাম গাছের মাটি থেকে যত্ন করে তুলে, শিকড়ের যে অংশে বাদাম ধরেছে, সেই অংশটুকু বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কাজ করেন। রোদে দিয়ে ছাড়িয়ে বাজারজাত করার আগে পর্যন্ত এই কাজটা অবশ্য বাড়ির মহিলারই করেন। অনুরেখা মদুমদার, মধুমিতা মণ্ডল, কবিতা মণ্ডলেরা জানাচ্ছেন, এত পরিমাণ বাদাম শুধুমাত্র বাড়ির মহিলাদের পক্ষে ছাড়ানো সম্ভব হয় না। অন্য পাড়া বা গ্রামের মহিলাদেরও কাজে লাগাতে হয়। প্রতি কিলোগ্রাম বাদাম বের করার জন্য মহিলারা পান দু’-আড়াই টাকা। এক মাস ধরে যেহেতু বাদাম ছাড়ানোর কাজ চলে, সেই সময় তাঁদের রোজগারটা মন্দ হয় না। এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে খয়রাশোল ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা দেবব্রত আচার্য বলেন, ‘‘বীজ সঠিক ভাবে শোধন করে বাদাম চাষ করলে এবং প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করলে সমস্যার কিছু নেই। চাষ অর্থকরী হওয়ায় জেলায় ধীরে ধীরে বাদাম চাষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন