১৬ই এপ্রিল অর্থাৎ ভোটের আগেরদিন।
ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। খুব সকালেই সিউড়ির এলসি কলেজে(ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার)পৌছে গেলাম। আমি ছিলাম রিজার্ভ প্রিসাইডিং অফিসার। আন্তরিক ভাবে চেয়েছিলাম ওই পোস্টিং পাওয়ার। কেন না, বছরের ওই একটা দিনই মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাই! বছরের বাকি দিনগুলো তো আমরা মাস্টার। বেশ মনে পড়ে, পোল্যান্ডের ওয়ারশতে গবেষণারত আমার এক বন্ধু আমায় ঠাট্টা করেছিল একবার। যার কোনও উত্তর ছিল না আমার কাছে! ফেসবুকে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী রে চাকরি বাকরি পেলি না মাস্টারিই করছিস?”
পোস্টিং হল। গন্তব্য ‘গাংমুড়ি প্রাইমারি স্কুল।’
জায়গাটা রাজনগর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, রানিনগরের কাছাকাছি। আর কিছুটা গেলেই ঝাড়খণ্ড বর্ডার। গ্রামটা সাদাসিধে, সহজ-সরল মানুষের গ্রাম। চারটে পোলিং পার্টি নিয়ে যখন বাস ছাড়ল তখন গরমে ঘেমে, ক্লান্তিতে, ক্ষিদেয় শরীর ও মন অবসন্ন। প্রায় এক ঘন্টা বাস চলার পর বুথ। জীর্ণ-শীর্ণ প্রাইমারি স্কুল। উন্নয়ণের চিহ্ন মাত্র নেই।
প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে গুরুদায়িত্বটাও যেমন নিজের কাঁধে নিতে হয় তেমনই দলের অন্যান্য সদস্যের সুখ-স্বাচ্ছন্দের দিকটাও দেখতে হয়। বেহাল শৌচাগার। খড় ও ধুলোতে বুজে রয়েছে। কাছাকাছি কোনও টিউবওয়েল ও নেই। অগত্যা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মাঠ ছাড়া উপায় থাকল না। সুবিধে হয়েছিল গ্রামটা গাংমুড়ি হওয়াতে –পুকুর ও নদী দিয়ে মোড়া!
এ বার থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করার পালা। লাইট ও ফ্যানের ব্যবস্থা করতে কন্টিনজেন্সির তিন’শ টাকা ছাড়াও আরো দু’শ টাকা বেরিয়ে গেল। স্ব-নির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে সেদিন রাত ও ভোটের দিন দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলাম। প্রথম দিন আলুপোস্ত–ডিমের ঝোল ভাত পঞ্চাশ টাকা। পরের দিন আলুপোস্ত–চারাপোনার ঝোল-ভাত ষাট টাকা মিল পিছু। ওরাই জল এনে দিলেন টিউবওয়েল থেকে। তীব্র গন্ধযুক্ত পানের অযোগ্য জল। সেক্টর অফিসে ফোন করে জল ও ভোটের দিন ভোট করানোর জন্য প্রয়োজনীয় বেঞ্চ চাইলাম।
রাত তখন দশটা। ম্যাটাডোরে করে প্রয়োজনের তুলনায় কম বেঞ্চ এল, জল এল না!
পরের দিন খুব ভোরেই উঠতে হল। ভোট শুরু হল ঠিক সাতটায়। ভোট হচ্ছিল যাকে বলে ‘নাইফ্ থ্রু বাটার’-এর মতো। একবার দশটা নাগাদ লক্ষ্য করলাম বাইরে থেকে দু-তিন জন ভেতরে থাকা ভোটারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। সিআরপিএফ জওয়ানদের ঘটনাটা জানাতেই ‘ইনসাস’ ও ‘কার্বাইন’ উঁচিয়ে দু’জন তেড়ে গেল ওদের দিকে। একজন হুঙ্কার দিল ‘মিস্টার ইন্ডিয়া অ্যায়সা মত করো, জান চলি জায়েগি।’ আর কারও ট্যাঁ-ফুঁ শোনা যায়নি। জওয়ানদের কড়া পাহারায় নির্বিঘ্নভাবে ভোটপর্ব মিটল। বিকেল চারটেয় পোল ক্লোজ হলো। ৮৭ শতাংশ ভোট। তীব্র দাবদাহের মধ্যেও মানুষের ভোট দেওয়ার স্বতঃফূর্ত আবেগ দেখে ভালো লাগল। এ বার ফেরার পালা।
ফিরলাম এলসি কলেজে। নাম পরিবর্তন করে সে তখন ‘রিসিভিং সেন্টার!’ আবার একপ্রস্থ মাল জমা দেওয়ার লড়াই।
রাত্রি দশটা, বোলপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে হাঁটছি। ঠোঁটের কোণে একচিলতে যুদ্ধ জয়ের হাসি। যদিও জানি, তা ক্ষণস্থায়ী। কারণ পরদিন থেকে আবার সেই ‘মাস্টার!’
(লেখক রামপুরহাট রেলওয়ে আদর্শ বিদ্যামন্দির স্কুলের রসায়নের শিক্ষক)